পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন

লিবিয়া সংঘাতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত আনা, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি কিংবা আফগানিস্তানে অপহরণকারীদের হাতে আটক বাংলাদেশিদের উদ্ধারের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো দক্ষ নাবিকের মতো সামলেছেন তিনি...

সুলতানা লায়লা হোসেন, পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের হয়ে আরও তিনটি দেশের ‘সমদূরবর্তী’ রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে বরাবরই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে।

লিবিয়া সংঘাতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত আনা, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি কিংবা আফগানিস্তানে অপহরণকারীদের হাতে আটক বাংলাদেশিদের উদ্ধারের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো দক্ষ নাবিকের মতো সামলেছেন লায়লা। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান ‘যুদ্ধের’ ময়দান থেকে বাংলাদেশিদের নিরাপদে অন্যত্র প্রত্যাবাসনের মতো কঠিন কাজে নেতৃত্বে দিচ্ছেন এ নারী কূটনীতিক।

১১তম ব্যাচের বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা সুলতানা লায়লাকে ২০২০ সালের শেষের দিকে মরোক্কো থেকে পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত করে পাঠায় সরকার। মরোক্কোর দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে গত বছরের ৩০ জুন ওয়ারশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্ব পালন করতে পোল্যান্ড পৌঁছান তিনি।

পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকলে ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়েন লায়লা ও তার দল। কিন্তু হঠাৎ রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করলে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় তাদের। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এখন পর্যন্ত নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ কূটনীতিক। ইউক্রেনে থাকা বেশির ভাগ বাংলাদেশিকে নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যত্র প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এখনও কাজ করে যাচ্ছেন দেশটিতে থাকা প্রায় ৭০ বাংলাদেশিকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে

গত ২৮ সেপ্টেম্বর লায়লা হোসেন পোল্যান্ডের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশংসাপত্র (লেটার অব ক্রিডেন্স) অর্পণ করেন। দায়িত্ব নেওয়ার চার মাসের মাথায় শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়ার উত্তেজনা। এ পরিস্থিতি তাকে অতীতের লিবিয়া সংকটের সময় নেওয়া চ্যালেঞ্জের কথা মনে করিয়ে দেয়। নতুন চ্যালেঞ্জ যে আরও কঠিন হতে পারে সেজন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি।

পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকলে ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়েন লায়লা ও তার দল। কিন্তু হঠাৎ রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করলে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় তাদের। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এখন পর্যন্ত নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ কূটনীতিক। ইউক্রেনে থাকা বেশির ভাগ বাংলাদেশিকে নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যত্র প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এখনও কাজ করে যাচ্ছেন দেশটিতে থাকা প্রায় ৭০ বাংলাদেশিকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে।

সুলতানা লায়লার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। আলাপকালে তিনি ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া, ইউক্রেনে আটকে পড়া ‘বাংলার  সমৃদ্ধি’ জাহাজের ২৮ নাবিককে রোমানিয়ায় পৌঁছাতে সহায়তাসহ বর্তমান ও অতীতের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার গল্প তুলে ধরেন।  

রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা বলেন, ‘অতীতে আমি যখন অন্য দেশে দায়িত্বে ছিলাম, তখনও অনেক চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলা করতে হয়েছে। চ্যালেঞ্জ আগেও পার করেছি, এখনও পার করতে হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতি যখন একটু একটু করে খারাপের দিকে যাচ্ছিল, তখন থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। আমরা দূতাবাস থেকে পরিকল্পনা করে এগোচ্ছিলাম। আগেই কিছুটা কাজ গুছিয়ে রেখেছিলাম। এ বিষয়ে যারা আমাদের সহায়তা করতে পারে, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ করি। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কীভাবে বাংলাদেশিদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া যায়। এর মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমাদের মাঠে নেমে পড়তে হয়। আমরা মাঠে নেমে গেলাম। আনুষ্ঠানিকভাবে কাজও শুরু করলাম।’

‘আমরা পোল্যান্ড দূতাবাস থেকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করে ইউক্রেনে আটকেপড়াদের তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত তাদের সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে পোল্যান্ড সরকারের সঙ্গে কথা বলি, তারা যেন বর্ডার দিয়ে আমাদের লোকগুলো যেতে দেয়। আমাদের সহায়তা ও পরামর্শে একে একে বাংলাদেশিরা পোল্যান্ড সীমান্ত পার হতে থাকেন। পোল্যান্ড ছাড়াও রোমানিয়া, মলদোভা, অস্ট্রিয়া সীমান্ত দিয়ে যেন বাংলাদেশিরা প্রবেশ করতে পারেন, সেজন্য আমরা কাজ করি। বর্তমানে পোল্যান্ডে আমাদের সাতশর বেশি বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছেন। রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও মলদোভা হয়ে কিছু লোক গেছেন। এসব দেশে কিছু বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছেন।’

ইউক্রেনে এখনও আটকা পড়েছেন কিছু বাংলাদেশি। তাদের তথ্য তুলে ধরে সুলতানা লায়লা বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় সত্তরের কাছাকাছি বাংলাদেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাদের কয়েকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। বাকিদেরও আমরা খুব দ্রুতই সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে পারব।’

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনে আটকেপড়া ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের ২৮ নাবিককে রোমানিয়া পাঠানোর ক্ষেত্রে ওয়ারশ দূতাবাসের চ্যালেঞ্জের বিষয়টিও তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত। বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমাদের বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের এক নাবিক নিহত হয়েছেন। তিনি নিহত হওয়ার পর জাহাজ থেকে তার মৃতদেহসহ বাকি ২৮ নাবিককে সেখান থেকে নিরাপদে নিতে হয়েছে আমাদের। তাদের ইউক্রেন থেকে রোমানিয়ায় পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’

ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিদের দেশে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তাদের বেশির ভাগই দেশে যেতে রাজি নন। তবে যারা দেশে যেতে চাইবেন তাদের বাংলাদেশ সরকার থেকে টিকিট  দেওয়া হবে। যারা যেতে চান তাদের প্রত্যাবর্তনে আমরা সহযোগিতা করব। বাকি যারা এখনও ইউক্রেনে আছেন তাদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাব।’

এর আগে লিবিয়া সংঘাতে আটকেপড়া প্রায় ৩৭ হাজার বাংলাদেশি, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ২৬ বাংলাদেশি এবং আফগানিস্তানে অপহরণকারীদের হাতে আটক সাত বাংলাদেশিকে অক্ষত উদ্ধারের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো করেন সুলতানা লায়লা।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া সুলতানা লায়লা কূটনীতিক হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার আগে জাপানে অণুজীববিজ্ঞানী হিসেবে বৃত্তি পান। তবে কূটনীতিই পেশা হিসেবে বেছে নেন লায়লা। কূটনীতিক হিসেবে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কনসুলার অণুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে পাঁচ বছরের বেশি সময় কাজ করেন। এছাড়া দিল্লি ও ইয়াঙ্গুনে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। লস অ্যাঞ্জেলেসে কনস্যুলেট জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন সুলতানা লায়লা।

এনআই/আরএইচ