যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকেপড়া জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র ২৮ নাবিক দেশে পৌঁছেছেন। বুধবার (৯ মার্চ) দুপুর ১২টা ১ মিনিটে তাদের বহনকারী টার্কিশ এয়ারলাইন্সের টিকে-৭২২ ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ইউরোপ ও সিআইএস অনুবিভাগের মহাপরিচালক শিকদার ব‌দিরুজ্জামান ও অন্যান্য কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান।

আনুষ্ঠানিকতা শেষে মহাপরিচালক ব‌দিরুজ্জামান ব‌লেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আমাদের ২৮ জন ক্রুকে উদ্ধার করতে পেরেছি। পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও অস্ট্রিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সর্বোপরি সরকারের সহযোগিতায় তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। 

তি‌নি ব‌লেন, নিহত হাদিসুরের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। তার দেহাবশেষ অতিসত্বর দেশে নিয়ে আসব।

ক‌বে নাগাদ নি‌য়ে আসা হ‌বে জান‌তে চাইলে ব‌দিরুজ্জামান ব‌লেন, যত দ্রুত সম্ভব। এ সময়টা ফিক্সড ক‌রে বলা যাবে না। একটা দে‌শে যুদ্ধ চল‌ছে, সেখা‌নে মানুষ ঢুক‌তে পার‌ছে না। আমা‌দের আন্তরিকতা শতভাগ আছে। আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা সবই আছে।

দেশে ফিরে আসা ২৮ নাবিকের বিষ‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, ২৮ জন সবাই সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। তবে তারা ট্রমাটাইজড। তাদের মেডিকেল টেস্টসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।

এদিকে দেশে পৌঁছার পর বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের গ্রুপ ক্যাপ্টেন জি এম নূরে আলম তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসায় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, আমরা সবাই আনন্দিত যে, সুস্থভাবে দেশ ফিরতে পেরেছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও অস্ট্রিয়ার দূতাবাসের কঠোর পরিশ্রমের কারণে আমরা দ্রুত আসতে পেরেছি। এত দ্রুত দেশে ফিরতে পারব এটা ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়। 

একইসঙ্গে অত্যন্ত গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি আমাদের সহকর্মী ও থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের মৃত্যুতে। তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা তার মরদেহ হিমঘরে রেখে এসেছি। 

জি এম নূরে আলম বলেন, ২ মার্চ আমরা সবাই নিয়মিত ডিউটিতে ছিলাম। বিকেলে যখন আক্রমণ হয় তখন জাহাজের ব্রিজে আগুন লেগে গিয়েছিল। এরপর আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। হাদিসুর সেখানে থাকায় হামলায় মারা যান।

দেশবাসী অনেক দোয়া করেছেন উল্লেখ করে ক্যাপ্টেন আলম বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নৌ পরিবহনমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে বিভিন্ন পরামর্শ ও সাহস দিয়েছেন। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও ফোন করে আমাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেন। আমরা দেখেছি, প্রায় ৬০ কিলোমিটার হেঁটে রিফিউজিরা (ইউক্রেনের নাগরিকরা) সীমান্ত অতিক্রম করছেন। কিন্তু আমাদের এত পথ হাঁটতে হয়নি। 

যেদিন থেকে যুদ্ধ শুরু হয় সেদিন সকাল থেকেই অলভিয়া বন্দরের চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না বলে জানান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আলম।

এর আগে স্থানীয় সময় বুধবার রাত সোয়া ২টায় রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট থেকে ২৮ নাবিক দেশের উদ্দেশে রওনা করেন। তাদের ফ্লাইটটি ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে আজ ঢাকা অবতরণ করে।

এদিকে গতকাল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) উপ-মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মো. মুজিবুর রহমান জানান, জাহাজে হামলার ঘটনায় মারা যাওয়া থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মাদ হাদিসুর রহমানের মরদেহ ইউক্রেনের একটি বাংকারের ফ্রিজারে রাখা হয়েছে। সুবিধাজনক সময়ে মরদেহটি দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। 

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দর চ্যানেলে আটকে পড়ে বাংলার সমৃদ্ধি। ২ মার্চ রাত ৯টা ২৫ মিনিটে জাহাজটি হামলার শিকার হয়। হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান নিহত হন। জাহাজটিতে মোট ২৯ জন বাংলাদেশি নাবিক ছিলেন।

জীবিত ২৮ নাবিককে গত ৩ মার্চ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ইউক্রেনের একটি বাংকারে নেওয়া হয়। পরে তাদের নিরাপদে রোমানিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।

বিএসসি সূত্রে জানা গেছে, সিরামিকের কাঁচামাল ‘ক্লে’ পরিবহনের জন্য বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি তুরস্ক থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের জলসীমায় পৌঁছায়। সেখান থেকে কার্গো নিয়ে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল এটির। তবে যুদ্ধাবস্থা এড়াতে জাহাজটিকে সেখানে পৌঁছার পরপরই পণ্যবোঝাই না করে দ্রুত ফেরত আসার জন্য নির্দেশনা দেয় শিপিং কর্পোরেশন। শেষ মুহূর্তে পাইলট না পাওয়ায় ইউক্রেনের জলসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশের এই জাহাজ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অলভিয়া বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এআর/এমএইচএস/জেএস