দেশে স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম বেড়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ মানুষের বৈষম্যও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে চলমান ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তোরণ সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

শনিবার (২ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ কর্তৃক আয়োজিত ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

তারা বলেন, দেশে চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসা খরচের ৬৭ ভাগের বেশি ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে। এদিকে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছে না। কিছুদিন পর পর গণমাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।

সমালোচনা করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। সমালোচনা করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আমরা যথেষ্ট উন্নতি করেছি। তবে, আমাদের অনেক অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। অনেক দেশ জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ খরচ ব্যয় করে, আমাদের এক শতাংশেরও কম। তারপরও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এগিয়েছে। যেটি ইতিবাচক।

তিনি বলেন, আমাদের ব্যক্তি খরচ অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণ রোগীরা বিনামূল্যে ওষুধ পেলেও বহির্বিভাগে এখনো সেটি সেভাবে করা যায়নি। ফলে এ ব্যয় বেড়েই চলেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য, জেলা সদর হাসপাতালসহ চিকিৎসার প্রতিটি স্তরে যে জনবল সংকট সেটিরও সমাধান দরকার।

জেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে রুহুল হক বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জেলাভিত্তিক পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিয়মিত ডাক্তার থাকা, টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা রেফারেল সিস্টেম চালু করতে না পারব, ততদিন এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে একজন চিকিৎসক দুই সপ্তাহের ছুটিতে গেলে কয়েকদিনের জন্য আরেকজন চিকিৎসক এনে বসানো হয়। কিন্তু চিকিৎসক যদি পর্যাপ্ত থাকত, তাহলে এমনটা হতো না। মানুষও ঠিকমতো সেবা পেত। আমাদের অবকাঠামো অনেক ভালো। সঙ্গে যদি এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে প্রকৃতপক্ষেই মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোপারেশন এজেন্সির (সিডা) স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যে যে বৈষম্য বাড়ছে, সেটি খুবই দুঃখজনক। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, অনেক মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। গড় আয়ু বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা ভালো না হওয়ায় শেষ সময়ে গিয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বয়স্করা। এজন্য একটি স্বাস্থ্য কমিশন জরুরি। সরকার যদি নাও করে ব্যক্তি উদ্যোগে হলেও এটি হওয়া দরকার।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে একটা পরিবর্তন হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ৫০ বছরের স্বাস্থ্য খাত কেমন হবে সেটিও এখন থেকে ভাবতে হবে। প্রতিদিনের স্বাস্থ্যসেবা আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচারে ইতিবাচক কিছু রাখছে কিনা, সেটিও ভেবে দেখার সময় হয়েছে বলেও মত দেন তিনি। 

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. মালেকা বানু বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমাদের সংবিধানেও এটি ভালোভাবে বলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে যে নারী আন্দোলন হয়েছে, এর মধ্যে নারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, নিরাপদ গর্ভপাত রক্ষা করাসহ অনেক কাজ করেছে নারীরা। নারীর ক্ষমতায়নে নারীর অধিকার নিয়ে, পুরুষদের সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছে মহিলা পরিষদ।

তিনি বলেন, দেশে কোনো কার্যকরি স্বাস্থ্যনীতি নেই। এজন্য এমন একটি নীতিমালা আমরা চেয়েছি, যেখানে লিঙ্গভিত্তিক কোনো বৈষম্য থাকবে না। আমাদের স্বাস্থ্য বাজেট অপ্রতুল, অব্যবস্থাপনা আরও বেশি। করোনা মহামারিতে সেটা আমরা দেখেছি। এমডিজিতে আমাদের সাফল্য কেবলমাত্র সংখ্যায় হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেটি তেমনটা প্রভাব ফেলেনি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করার লক্ষ্যে আড়াই বছর আগে দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নেয়। দেশি ও প্রবাসী ৯৯ জন জনস্বাস্থ্যবিদ, গবেষক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, শিক্ষক এবং সাংবাদিক এই গ্রন্থটি লিখেছেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ নামের ২০ অধ্যায়ের গ্রন্থটির প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন। গ্রন্থটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের পঞ্চাশ বছরের খতিয়ান।

সিপিডির সম্মানিত ফেলো ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রওনক জাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক রেহমান সোবহান। 

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটির সভাপতি, জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সিডার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. জহিরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহবায়ক আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী।

টিআই/এসএম