কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। কিন্তু এসব দেশে এখন বৈধভাবে শ্রমিকরা যেতে পারছেন না।

করোনার ধাক্কায় টালমাটাল হয়েছে গোটা বিশ্ব, বড় হোঁচট খেয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। আঘাত এসেছে দেশের প্রবাসী শ্রমবাজারেও। বিপুল অংকের রেমিটেন্স আসার এই খাতে লেগেছিল মন্দ হাওয়া। 

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এই পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমবাজার সংক্রান্ত নতুন কোনো বার্তা বা চুক্তি আলোর মুখ দেখছিল না। তবে সম্প্রতি ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের সঙ্গে শ্রমবাজার সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। আশার কথা হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই প্রথম কোনো দেশের সঙ্গে শ্রমবাজার নিয়ে চুক্তি হলো; যেখানে নতুন করে জনবল নিয়োগ, অবৈধ কর্মীদের বৈধতা প্রদান ও ফেরানোর প্রক্রিয়া যুক্ত রয়েছে। 

করোনার কারণে সংকীর্ণ হতে থাকা শ্রমবাজার নিয়ে মালদ্বীপের সঙ্গে হওয়া নতুন চুক্তিটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশটিতে নতুন করে কর্মী পাঠানোর আগে সেখানে থাকা অবৈধদের বৈধকরণ জরুরি। সেইসঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তাদের।

আশা করি এই চুক্তির মাধ্যমে একটা উদাহরণ সৃষ্টি হবে। তাহলে অন্য দেশগুলোকেও এটা বলা যাবে আমরা মালদ্বীপের সঙ্গে যেভাবে চুক্তি করেছি সেই প্রক্রিয়ায় করতে চাই। 

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের আমন্ত্রণে চারদিনের সফরে গত সোমবার রাতে ঢাকায় আসেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লা শহিদ। সফরের প্রথম দিন মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় চলে মোমেন-শহিদের নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধিদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি সময় নিয়ে চলে বৈঠকটি।  

বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে উভয় পক্ষ থেকে জানানো হয়, শ্রমবাজার সংক্রান্ত এবং বাংলাদেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির সঙ্গে মালদ্বীপের ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটের মধ্যে দুটি চুক্তি করতে যাচ্ছে ঢাকা ও মালে।

দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা-মালে নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিত করতে একমত হয়েছে উভয়পক্ষ। সেইসঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আরও নিবিড় করতে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে দুই দেশ যৌথ কমিশন গঠন করতে একমত হয়েছে।

এরপর ওইদিন বিকালে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করে দুই দেশ। শ্রমবাজার সংক্রান্ত চু‌ক্তিতে ঢাকার প‌ক্ষে ছিলেন প্রবাসী কল‌্যাণ ও বৈ‌দে‌শিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণাল‌য়ের স‌চিব ড. আহ‌মেদ মু‌নিরুস সা‌লেহীন এবং ফ‌রেন সা‌র্ভিস একা‌ডে‌মির চু‌ক্তি‌তে সই ক‌রেন রাষ্ট্রদূত গোলাম ম‌সিহ। আর মালের পক্ষে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্র স‌চিব আবদুল গফুর মোহাম্মদ।

শ্রমবাজার সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ

বেসরকারি হিসেব বলছে, মালদ্বীপে বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় লাখ খানেকের মতো বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই দেশটির নির্মাণশিল্পে কাজ করছেন। তবে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশটিতে ৮০ হাজার বাংলাদেশিকর্মী রয়েছে।

মালের সঙ্গে হওয়া শ্রমবাজার সংক্রান্ত চুক্তি প্রসঙ্গে অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সি আর আবরার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নতুন করে কর্মী নেওয়া, অবৈধদের বৈধকরণ কিংবা প্রত্যাবাসনে হওয়া এই চুক্তিটা যথেষ্ট ইতিবাচক। তবে নতুন শ্রমিক পাঠানোর আগে যারা ওখানে অনিয়মিত, তাদের বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে মালদ্বীপকে বলতে হবে। কারণ অনেক কর্মী সেখানে পরিস্থিতির কারণে অবৈধ হয়ে গেছে বলে শুনেছি। চুক্তিটি যেন কার্যকর করা হয় বাংলাদেশকে সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের তাগাদা দিতে হবে।’

মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের আয়োজনে মার্চে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ ঢাকায় আসতে পারেন। তার সফর নিশ্চিত হলে দেশটির সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার বিষয়ে ঢাকার আগ্রহের বিষয়টি জানানো হবে। এ বিষয়টি আগাম বার্তা হিসেবে দেশে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়েছে।  

সরকারি তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৭২টি দেশে কাজ নিয়ে যায় বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এরপরেই রয়েছে ওমান, কাতার, বাহরাইনের মতো দেশগুলো। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। কিন্তু এসব দেশে এখন বৈধভাবে শ্রমিকরা যেতে পারছেন না।  

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, মহামারির কারণে গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। এরমধ্যে মালদ্বীপ থেকে ফেরত এসেছেন প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী। অবশ্য এরপর দুই মাসের বেশি সময় দেশটি থেকে আরও কত কর্মী ফেরত এসেছেন তার তথ্য-উপাত্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করছে না প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘ওখানে যেসব বাংলাদেশি কর্মী অবৈধ হয়ে গেছেন তাদের যাতে রেগুলারাইজ (নিয়মিতকরণ) করা হয় সেটাকে স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু নতুন যারা যাবে তারা যেন ভবিষ্যতে অবৈধের আওতায় না পড়ে যায়, সেই নিয়মটা যেন রাখা হয়। সরকারের উচিত হবে ভবিষ্যতে শ্রমবাজার এবং আমাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য অভিবাসীদের কাছে একটু সহায়তা চাওয়া। যেসব অভিবাসীরা জীবিকার তাগিদেই সেখানে থাকতে চায়, কিন্তু সেটা যেন নিয়মের মধ্যেই হয়। এতে করে ভবিষ্যতে দেশটিতে আরও লোক যেতে পারবে, সম্পর্কটা ভালো থাকবে। আশা করি এই চুক্তির মাধ্যমে একটা উদাহরণ সৃষ্টি হবে। তাহলে অন্য দেশগুলোকেও এটা বলা যাবে আমরা মালদ্বীপের সঙ্গে যেভাবে চুক্তি করেছি সেই প্রক্রিয়ায় করতে চাই।’

চারদিনের সফর শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দেশে ফিরে গেছেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শহিদ। যাওয়ার আগে বুধবার সকালে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন করেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দেশটিকে জলবায়ু মোকাবিলায় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সবশেষ সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এনআই/এনএফ