চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কচুক্ষেত রজনীগন্ধা টাওয়ারে রাঙাপরী জুয়েলার্স থেকে তালা ভেঙে চুরির ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব বলছে, ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখার ভল্ট ভেঙে ২ কোটি টাকা চুরির সাথেও এই চক্রটি জড়িত।  

এছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জে ৪৫৫ ভরি স্বর্ণসহ দুই লক্ষাধিক টাকা, ডেমরায় ২৩০ ভরি স্বর্ণসহ লক্ষাধিক টাকা লুটের সাথেও এ চক্র জড়িত। প্রায় এক যুগ ধরে ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালংকার লুটকারী এই চক্রের মূল হোতা রাজা মিয়া। তাকেসহ কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার (৪২) এবং মাসুদ খান (৪২) নামে তার দুই সহযোগীকে সোমবার রাতে মুন্সিগঞ্জ ও বরিশাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪ এর দুটি বিশেষ দল তাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি উদ্ধার করে ১৯.৭০ গ্রাম স্বর্ণ ও নগদ ৩ লাখ ২৯ হাজার ১৮০ টাকা।  

র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন  বলেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্স নামে একটি স্বর্ণের দোকান থেকে প্রায় ৩০০ ভরি স্বর্ণ লুটের একটি দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় রাঙাপরী জুয়েলার্সের মালিক আবুল কালাম ভূঁইয়া ভাষানটেক থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
র‌্যাব পরবর্তীতে ঘটনার বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণসহ জড়িতদের শনাক্তে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে।  

সাংবাদিকদের কাছ পাঠানো একটি রেকর্ডেড ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেন তিনি। 

জয়পুরহাটে ব্র্যাক ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে ২ কোটি টাকা চুরি
তাদের অতীত অপরাধের রেকর্ড তুলে ধরে র‌্যাব জানিয়েছে, ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখার ভল্ট ভেঙে এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা লুট করেছিল চক্রটি। ওই ঘটনায় তারা ব্যাংকের পাশের একটি ঘর এনজিও’র মিথ্যা পরিচয়ে ভাড়া নেয়। ভল্ট লুটের এক সপ্তাহ আগে থেকে দেওয়াল কেটে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে ওই টাকা লুট করে পালিয়ে যায় তারা। পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানে রাজা মিয়াসহ সাত সদস্য গ্রেপ্তারও হন। ওই ঘটনায় রাজা মিয়া তিন বছর কারাভোগ করে।

সিদ্ধিরগঞ্জে ৪৫৫ ভরি স্বর্ণ-দুই লক্ষাধিক টাকা লুট
একইভাবে তারা ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দুইটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি স্বর্ণ ও ২ লাখ টাকা লুট করে। পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানে বাচ্চু মাস্টার, রাজা মিয়া ও মাসুদ খানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তারা কারাভোগ করেন।

ডেমরায় ২৩০ ভরি স্বর্ণ-লক্ষাধিক টাকা লুট
২০২০ সালে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায় স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি স্বর্ণ ও ১.৫ লক্ষ টাকা লুট করে এই একই চক্র। ওই ঘটনার দুই মাস আগে চক্রের তিন সদস্য মিথ্যা পরিচয়ে একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে যোগ দেয়। এতদিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে তারা গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম ছিল।

রজনীগন্ধা মার্কেটে যে কৌশলে ডাকাতি
বাচ্চু মাস্টার রজনীগন্ধা মার্কেটে স্বর্ণের দোকান লুটের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার দেড় মাস আগে ভুয়া পরিচয়ে একটি দোকান ভাড়া নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই দোকানে নামসর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুদ করে।

রাজা মিয়া, বাচ্চু মাস্টারসহ আরও ৩ থেকে ৫ জন সদস্য ঘটনার দিন রাত ১২টায় মিরপুর-১৪, গোলচত্বরে একত্রিত হয়। বাচ্চু মাস্টার তাদের ১টা নাগাদ মার্কেটে আসতে বলেন। এই সময়ের মধ্যে বাচ্চু মাস্টার মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মীদের কৌশলে খাবার ও পানীয়ের সাথে চেতনানাশক সেবন করিয়ে অজ্ঞান করে। এরপর তারা নিজেদের ভাড়া করা দোকানে ঢুকে সেখানে আগে থেকে রাখা তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শাটার ভেঙে দোকানের ভেতর প্রবেশ করে। এরপর স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে নিজেদের দোকানে নিয়ে যায়। এরপর সমস্ত মালামাল কেরানীগঞ্জে বাচ্চু মাস্টারের বাসায় নিয়ে ভাগাভাগি করে যে যে যার যার গ্রামের বাড়িতে চলে যান।   

বাসের কন্ডাক্টর থেকে দুর্ধর্ষ ডাকাত রাজা
র‌্যাব বলছে, রাজা মিয়ার তালা ভাঙয় দক্ষতা রয়েছে এবং অন্যান্যরা বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী। ১৯৯০ সালে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন রাজা মিয়া। ২০০২ সালে সংঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। পাশপাশি লুট ও ডাকাতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মার্কেটে রেকি করতে শুরু করেন রাজা।

অর্ধ-শতাধিক চুরি-ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে র‌্যাবের কাঝে স্বীকার করেছেন রাজা। 

আইনজীবীর অফিস সহকারি থেকে স্বর্ণ লুট চক্রে বাচ্চু মাস্টার
২০০৯ সালে ঢাকায় এক আইনজীবীর অফিস সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করেন বাচ্চু মাস্টার। ২০১৮ সালে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের এক সদস্য আদালতে এলে সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই ব্যক্তির সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের স্বর্ণালঙ্কার লুটে অংশ নেন বাচ্চু মাস্টার। এর মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ ও র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। চুরি ডাকাতির পরিকল্পনা ও ভুয়া সব কিছু তৈরিতে সিদ্ধহস্ত হওয়ায় চক্রে তার উপাধি মেলে মাস্টার।

রেস্টুরেন্ট বয় থেকে ডাকাতিতে মাসুদ
মাসুদ ঢাকার একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ক্লিনার ও বয় হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেছিলেন। ২০১০ সালের দিকে রেস্টুরেন্টে থাকতেই এক সদস্যের মাধ্যমে চক্রে সখ্যতা ও যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে থাকা অবস্থায় সিদ্ধিরগঞ্জের হাজী আহসান উল্লাহ সুপার মার্কেটের দুটি স্বর্ণের দোকানের প্রায় দুই কেজি স্বর্ণ লুট করেন। সেই লুটের ঘটনায় পরে কারাভোগও করেন। তার নামে চুরির তিনটি মামলা রয়েছে।

জেইউ/এনএফ