রাত-দিন শিফটে চাঁদাবাজি, না দিলে মারধর-হয়রানি
রাত-দিন শিফটে ভাগ করে রাজধানীতে চলছে ছিনতাই-চাঁদাবাজি। সবজি-ফলের দোকান, ফুটপাতে অস্থায়ী দোকান, এমনকি লেগুনাস্ট্যান্ডও বাদ নেই। মালবাহী গাড়ি থেকে মালামাল লোড-আনলোডেও নেওয়া হয় চাঁদা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রত্যেক দোকানির কাছ থেকে দৈনিক চাঁদা নেওয়া হয় পাঁচশ থেকে হাজার টাকা। কেউ চাঁদা না দিলে নানাভাবে হয়রানি-হুমকি দেওয়া হতো।
পবিত্র মাহে রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে লক্ষ্য করে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা অলিগলিতে ওঁৎ পেতে থেকে পথচারী, রিকশা আরোহী, যানজটে থাকা সিএনজি, অটোরিকশার যাত্রীদের ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নিত। তাদের উৎপাতে রাজধানীতে নিরাপদে ঈদের কেনাকাটা, মানুষের বাড়ি ফেরা ও ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনা যেন হুমকির মুখে।
বিজ্ঞাপন
এ অবস্থায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীতে পৃথক ১৫টি অভিযান পরিচালনা করে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর রমনা, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ ও ওয়ারী এলাকা থেকে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ ৩৩ জন ও ছিনতাইয়ে জড়িত ২০ জনসহ ৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, মাহে রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিছু সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সবজি ও ফলের দোকান, ফুটপাতের অস্থায়ী দোকান, লেগুনাস্ট্যান্ড এবং মালবাহী গাড়ি থেকে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে চাঁদা আদায় করে আসছে।
কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে তারা জীবননাশের হুমকি দেয়। র্যাব অভিযোগ পেয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৩ এর কয়েকটি দল একযোগে রাজধানীর রমনা, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন ও ওয়ারী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চাঁদাবাজ চক্রের ৫৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তাররা হলেন— আওয়াল (৪৫), আতিক (৩৫), আলাউদ্দিন (৪৫), ইসমাইল (৫৪), জুয়েল (৪৩), দুলাল (৪৫), বদির উদ্দিন বাবু (৫০), বাবুল (৫২), বাবুল হাওলাদার (৪৯), মোস্তফা হাওলাদার (৫০), সাহেব আলী (৫৪), তানভির (৪০), জালাল হোসেন (৩০), নিয়ামুল হোসেন (২৯), ময়নুল হোসেন (৪৫), মিন্টু খান (২৫), মেনু মিয়া (৩৮), রনি (৩১), রানা (২৪), শরীফ সরকার (৩৫), মহসীন (২৫), রনজিৎ দাস (৪৮), রাসেল শিকদার (২১), হারেজ (৪৩), বাদশা (২৯), আল আমীন সর্দার (২০), শহীদ (২৭), রাজু (৩৫), রফিক (২৫), রোমান (৪২), আকবর (২০), ইমন (১৯), রাব্বি (১৯), হৃদয় (১৯), মো. হোসেন (১৯), আল আমিন (২২), ইসমাইল হোসেন (২২), নাইমুল ইসলাম মিশু (২৫), নুরুল হক (২৫), রতন (২২), রাব্বি (১৯), শফিকুল ইসলাম (২৪), সাগর হোসেন শামীম (২০), উজ্জল মিয়া (২০), আক্কাছ (৫০), ইউছুফ (৩২), জাহিদ (৪৪), মুন্সি মুছা আহমেদ (৫২), রবিন মিয়া (৩২), সাগর (২৭), সুজন (৪৫), সোহাগ মৃধা (৩২) এবং সোহেল সরকার (৩১)।
এ সময় চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করা নগদ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩০ টাকা, ৬০টি মোবাইল ও ৪৫টি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সবজি-ফলের দোকান, ফুটপাতের অস্থায়ী দোকান, লেগুনাস্ট্যান্ড এবং মালবাহী গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করে আসছিল তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রত্যেক দোকানির কাছ থেকে তারা দৈনিক ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করে আসছিল।
তিনি বলেন, ওয়ারী থানাধীন কাপ্তান বাজারে চাঁদাবাজি শুরু হয় রাত ১২টার পর, যা চলে ভোর পর্যন্ত। পোল্ট্রি মুরগি বহনকারী কোনো গাড়ি এ বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির ধরন ও মুরগির পরিমাণ দেখে নির্ধারণ করা হতো চাঁদার পরিমাণ। যা জোরপূর্বক আদায় করা হয়। চাঁদা না দিলে নানাভাবে হয়রানি, মালামাল আনলোড ও বিক্রিতে বাধা দিত। প্রতি রাতে এখান থেকে আদায় করা হতো কয়েক লাখ টাকা।
রমনা থানার শান্তিনগরে মূলত রাস্তার ধারে ভাসমান দোকান থেকে নির্দিষ্ট হারে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয়। সকাল ও বিকেলে দুই শিফটে চাঁদা আদায় করা হয়। এ কাজে চার/পাঁচ জনের একটি গ্রুপ জড়িত। প্রতিদিন এখান থেকে লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করা হয়।
কমান্ডার মঈন বলেন, লেগুনাস্ট্যান্ডে তাদের কথা মতো কেউ চাঁদার টাকা না দিলে কোনো রুটে লেগুনা চলতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেয়। তখন লেগুনা চালকরা পেটের দায়ে বিনা প্রতিবাদে চাঁদা পরিশোধ করেন। এসব চাঁদাবাজকে আইনের আওতায় আনার ফলে নিরীহ দোকানদার ও লেগুনা চালকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মালিবাগ রেল গেট, দৈনিক বাংলা মোড়, পীরজঙ্গি মাজার ক্রসিং, কমলাপুর বটতলা, মতিঝিল কালভার্ট রোড, নাসিরের টেক হাতিরঝিল, শাহবাগ, গুলবাগ, রাজউক ক্রসিং, ইউবিএল ক্রসিং পল্টন মোড়, গোলাপ শাহ’র মাজার ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং, আব্দুল গণি রোড, মানিকনগর স্টেডিয়ামের সামনে, নন্দীপাড়া ব্রিজ, বাসাবো ক্রসিং এলাকায় সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়েছে বলে জানান র্যাবের এ কর্মকর্তা।
নিরাপদে ঈদের কেনাকাটা ও স্বস্তিতে বাড়ি ফেরা, নির্ভয়ে ব্যবসা প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। র্যাবের এ অভিযানে স্বস্তি ফিরেছে। চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে র্যাবের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান খন্দকার আল মঈন।
জেইউ/এসএসএইচ