কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে সেচ প্রকল্পের বিবাদকে কেন্দ্র করে মোরশেদ আলীকে হত্যা ও পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। ইফতারি পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার আকুতি করেও রক্ষা পাননি মোরশেদ।

র‌্যাব বলছে, গ্রেপ্তার মাহমুদুল হক ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা স্বীকার করেছে, সেচ স্কিম পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে এলাকার প্রতিবাদী মোরশেদ আলী তাদের পথের কাটা ছিল। মোরশেদ আলী আসামিদের সব প্রকার অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে এলাকায় তাদের প্রকৃত মুখোশ খুলে যায়। অন্যায়ের প্রতিবাদের কারণে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মোরশেদকে হত্যা করে। 

শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) চান্দগাঁও ক্যাম্পে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৭ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ।

গ্রেপ্তার ৫ জন হলেন মাহমুদুল হক (৫২), তার ভাই মোহাম্মদ আলী, মাহমুদুল হকের ছেলে আবদুল্লাহ (৩০), আব্দুল আজিজ (২৮)। এছাড়া ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নুরুল হক (৫৩)। 

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, যখন আসামিরা মোরশেদকে মারধর করছিল, তখন তিনি (মোরশেদ) বারবার আকুতি মিনতি করে বলেছিল ইফতারির আগ পর্যন্ত তাকে ধরে রাখার জন্য। ইফতারির পর তাকে যা খুশি তা করার জন্য বলে। কিন্তু আসামিরা মোরশেদের কোন কথা শুনেননি। তাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তারের পর আসামিরা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার মাহমুদুল হক তার তিন ছেলে, মাহমুদুলের ভাই মোহাম্মদ আলী ও আরও ১০ থেকে ১২ জন মিলে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। ঘটনায় বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। 

তিনি বলেন, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মাহমুদুল ঘটনাটিকে প্রথমে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গ্রেপ্তারের পরে মাহমুদুল স্বীকার করে, তার নিজের পরিকল্পনায় মোরশেদকে হত্যা করা হয়। নিজের সেচ ব্যবসাকে মজবুত করার জন্য এই কাজ করেন তিনি। 

র‍্যাব জানায়, মাহমুদুলরা সেচ প্রকল্পে মনোপলি ব্যবসা করছিল। সবাইকে জিম্মি করছিল। সবাইকে তাদের কাছ থেকে সেচ প্রকল্পে পানি নিতে হতো। আর তারা যে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তা দিয়ে পানি নিতে হতো। এইসব কারণে মোরশেদ প্রতিবাদ করছিল। কয়েকজন কৃষক সঙ্গে নিয়ে রেট কমানোর দাবি করেছিল। এছাড়া সেচ ব্যবসা ভাগ করার কথাও বলছিল। মাহমুদুল মনে করছিল মোরশেদ তার সেচ ব্যবসার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তাকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা থেকে তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে রাজনৈতিক কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। মাহমুদুলদের সেচ ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্য পারিবারিক ভাবে তারা মোরশেদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, ৭ এপ্রিল কক্সবাজার সদর থানার চেরাংঘর স্টেশনের তরকারির দোকানের সামনে মধ্যযুগীয় কায়দায় দা, হাতুড়ি, কিরিচ, লোহার রড ও লাঠি দিয়ে জনসম্মুখে নির্মম ও নৃশংসভাবে কুপিয়ে মোরশেদ আলীকে (৪০) হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় মোরশেদের ভাই জাহেদ আলী বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরও ৮ থেকে ১০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। 

তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে অসামিরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে টেকনাফ চলে যায়। সেখান থেকে তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোন উকিল ম্যানেজ করতে পারেনি। পরবর্তীতে তারা ঢাকায় হাইকোর্টে গিয়ে জামিন নেওয়ার চিন্তা করে। এরই প্রেক্ষিতে তারা মাইক্রোবাস যোগে ঢাকায় যাওয়ার চিন্তা করে। এই তথ্য পেয়ে শুক্রবার ভোরে র‌্যাব টেকনাফে অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। 

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা ১০নং পানি সেচ স্কিম নিজেদের দখলে নিয়ে চাষিদের নিকট হতে অতিরিক্ত টাকা দাবিসহ অন্যায় অত্যাচার করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে আসছিল। মোরশেদের পরিবারের সদস্যরা স্কিম ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকলে আসামিরা তাদের উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। নিহত মোরশেদ আলী ছিলেন একজন অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। মোরশেদ আলী দুষ্কৃতিকারীদের বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করায় বিভিন্ন সময় প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছিল। 

তিনি বলেন, ঘটনার দিন মোরশেদ বাড়ি থেকে বের হয়ে ইফতারি কেনার জন্য। কক্সবাজার সদর থানাধীন চেরাংঘর ষ্টেশনের তরকারির দোকানের সামনে পৌঁছালে দুস্কৃতিকারীরা দুই দিকের রাস্তা বন্ধ করে মোরশেদকে মাটিতে ফেলে প্রথমে ধারালো কিরিচ দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় গুরুতর জখম করে। এরপর আবদুল্লাহ ও আব্দুল আজিজ লাঠি ও লোহার রড দিয়ে মোরশেদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করলে মোরশেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে মাহমুদুল হক ধারল কিরিচ দিয়ে মোরশেদ আলীর ডান হাতে কোপ দিয়া কব্জি থেকে হাত প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মোহাম্মদ আলী হাতুড়ি দিয়ে মোরশেদের অণ্ডকোষে উপুর্যপুরি আঘাত করে। 

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, মাহমুদুল হক ছিল এই এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। মাহমুদুল তার পরিবারের প্রধান হয়ে তার ভাই মোহাম্মদ আলীসহ সবার সঙ্গে পরিকল্পনা করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মদদদাতা ছিলেন মাহমুদুল হকের আরেক ভাই নুরুল হক। 

কেএম/আইএসএইচ