ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিপণিবিতানে জমে উঠেছে কেনাকাটা। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে বিকিকিনি। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে মার্কেটগুলোতে ক্রেতার উপস্থিতি তত বাড়ছে। দোকানিরা বলছেন, ১০ রোজার পর থেকে এবার জমে উঠেছে ঈদ-কেন্দ্রিক কেনাকাটা।

গত দুই বছর করোনার কারণে নানা বিধিনিষেধ থাকায় আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেননি দোকানিরা। এবার রাষ্ট্রীয় কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় এবং ক্রেতাদের উপস্থিতি বেশি হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তারা বলছেন, ১০ রমজানের পর থেকে বিক্রি বেড়েছে। শেষ দিকে বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা করছেন তারা।

রোববার সরেজমিনে চট্টগ্রাম নগরীর টেরিবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে মার্কেটে ক্রেতাদের ভিড় লেগে আছে। সকাল থেকে রাত ১টা/২টা পর্যন্ত চলে কাপড় বিক্রি। এক সময় কাপড়ের পাইকারি বাজার হিসেবে এই বাজারের সুখ্যাতি থাকলেও সময়ের ব্যবধানে খুচরা কেনাকাটার জন্যও টেরিবাজার সুনাম কুড়াচ্ছে। কাপড়ের পাইকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সময়ের বিবর্তনে এখানে স্থান করে নিয়েছে আধুনিক শপিংমল ও মেগাশপ।

ব্যবসায়ীরা জানান, টেরিবাজারে ছোট-বড় প্রায় ৮৫টি মার্কেট রয়েছে। এখানে দোকানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এসব দোকানে শাড়ি, থ্রিপিস, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি, শার্ট থেকে শুরু করে থানকাপড়, কসমেটিকসসহ সাজসজ্জার নানা উপকরণ পাওয়া যায়।

সারোয়ার আলম নামে এক ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন টেরিবাজারে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের সময় যত এগিয়ে আসবে ততই ভিড় বাড়বে। আজ গিফট দেওয়ার জন্য কিছু কাপড় কিনতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম রাতে ঝামেলা কম হবে। রাতেও দেখি অনেক ভিড়। একসঙ্গে অনেক দোকান থাকায় প্রতি বছর টেরিবাজার থেকেই কেনাকাটা করি।

আনোয়ারুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, বোনের জন্য একটি শাড়ি পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু দাম বেশি বলায় নিতে পারিনি। কাপড়ের দাম অন্য বছরের তুলনায় বেশি মনে হচ্ছে।

টেরিবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, শবে বরাতের পর থেকে তাদের বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে ১০ রমজানের পর বিক্রি অনেক বেড়েছে।

টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শবে বরাতের পর থেকে রমজান শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রচুর বিক্রি হয়েছে। তারপর প্রথম রমজান থেকে ১০ রমজান পর্যন্ত বিক্রি কিছুটা কম হয়েছে। তবে ১০ রমজানের পর থেকে এখন প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা করছি। রমজানের শেষ দিকে ব্যাপক বেচাকেনা হয়।

তিনি বলেন, আমাদের সামনে চলে আসছে বলি খেলা ও মেলা। লালদিঘীর ময়দানে মেলা বসলে টেরিবাজারের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। মেলার কারণে মানুষের আসার রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, যানজট বেড়ে যাবে। ফলে ক্রেতারা টেরিবাজারে আসতে চাইবে না। আমরা সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করি। করোনার কারণে ২০২০ ও ২১ সালে ব্যবসা করতে পারিনি। ২০২২ সাল আমাদের ব্যবসার ভালো একটি সময়। এরপর রমজানের শেষ সময়ে এসে যদি বলি খেলা হয়, তাহলে আমরা বড় ক্ষতির মুখে পড়ব। বলি খেলা ও মেলা এখান থেকে সরিয়ে সিআরবিতে নেওয়ার অনুরোধ করছি।

টেরিবাজারের নিউ বঁধুয়া শপিং সেন্টারের পরিচালক এন এইচ রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে দুই বছর ঈদে তেমন বিক্রি হয়নি। এ বছর বিক্রি শুরু হয়েছে। আগের চেয়ে ক্রেতা সমাগম বেড়েছে। তবে দুই বছর পর যেমন বিক্রির আশা করেছিলাম, তেমন হচ্ছে না।

অন্যদিকে সব ধরনের কেনাকাটার জন্য চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেন খুবই জনপ্রিয়। কম দামে ভালো পণ্যের জন্য ক্রেতাদের পছন্দের বাজার এটি। ঈদ ঘিরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এ বাজারে ধনী-গরিব সব শ্রেণির ক্রেতার মেলবন্ধন ঘটে।

সোমবার সকালে রিয়াজ উদ্দিন বাজারের সিটি মার্টের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত দুই বছর ব্যবসায়ীরা এক প্রকার সংকটকাল কাটিয়েছে। দুই বছরের স্থবিরতা কাটিয়ে এবার ব্যবসা কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। এবার রমজানের শুরু থেকে ঈদের বেচাকেনা শুরু হয়েছে। ঈদ পর্যন্ত এ ভাব বজায় থাকবে বলে আশা করছি।

সকাল সকাল রিয়াজ উদ্দিন বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছেন মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরিবারের সাত সদস্যের জন্য ঈদের কেনাকাটা করছেন নাহিদুল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, শেষের দিকে শপিংমলে ভিড় বেশি হবে, তাই আগে কেনাকাটা করে নিলাম।

রিয়াজ উদ্দিন বাজারে জাকিয়া সুলতানা নামের এক গৃহবধূ বলেন, বাচ্চাদের নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছি। অন্য বছরের তুলনায় কাপড়ের দাম বেশি বলে মনে হচ্ছে। ঝামেলা এড়াতে সকালের দিকেই চলে এসেছি মার্কেটে।

রিয়াজ উদ্দিন বাজার ও টেরিবাজার ছাড়াও নগরীর নিউ মার্কেটের বিপণীবিতান, চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স, সানমার ওশ্যান সিটি, সিটি সেন্টার, ফিনলে সেন্টার, আমিন সেন্টার, ভিআইপি টাওয়ার, মিমি সুপার মার্কেট, আফমি প্লাজা, আখতারুজ্জামান সেন্টারে ক্রেতাদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।

জেন্টেল পার্কের সেলসম্যান অনিক আহম্মদ বলেন, রমজানের এক সপ্তাহ পর থেকে বিক্রি বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বে বলে আশা করছি।

মিমি সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান আকবর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মার্কেটে ঈদের বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে এখনও পুরোদমে জমে ওঠেনি। ২০ তারিখের পর থেকে পুরো দমে বিক্রি জমে উঠবে বলে আশা করছি। করোনার কারণে দুই বছর তেমন বিক্রি হয়নি। করোনা-পরবর্তী সময়েও যেভাবে বিক্রি হবে আশা করেছিলাম সেভাবে হয়নি। কারণ এখন দোকানপাট বেড়ে গেছে, অনলাইনে ব্যবসা বেড়ে গেছে। সেজন্য কাস্টমার কিছুটা কম মনে হচ্ছে আমার কাছে। করোনার আগে প্রচুর বিক্রি হতো। কারণ ওই সময় অনলাইনে এত ব্যবসা ছিল না।

স্বল্প আয়ের মানুষের ঈদের কেনাকাটার জন্য হকার্স মার্কেট অন্যতম। সেখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১০ রমজানের পর থেকে বিক্রি অনেক বেড়েছে। তবে মানুষ বেতন-বোনাস পেলে বিক্রি আরও বাড়বে।

হকার্স মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিক্রি মোটামুটি আছে। রোজার প্রথম দিকের তুলনায় এখন বিক্রি বাড়তে শুরু করেছে। বলতে পারি মার্কেট জমজমাট হতে শুরু করেছে। আশা করছি সামনে বিক্রি বাড়বে। যারা চাকরিজীবী তাদের অনেকেই এখনও বেতন-বোনাস পায়নি। বেতন-বোনাস পেলে বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, রোজার শেষ দিকে আমাদের বিক্রি বাড়ে। কিন্তু এই সময়ে মার্কেটের আশপাশের সড়কে জব্বারের বলি খেলাকে কেন্দ্র করে মেলা দেওয়া হচ্ছে। ২৪, ২৫ ও ২৬ তারিখ মেলা চললে ক্রেতারা এখানে আসতে চাইবে না। মেলার কারণে যানজট তৈরি হবে। ফলে ক্রেতারা মার্কেটে আসতে পারবে না। তাই আমাদের দাবি মেলা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক।

করোনার বিধিনিষেধ না থাকায় এবার মার্কেটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাইও নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব মানার ন্যূনতম প্রবণতাও তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। দুএকজন মাস্ক পড়লেও অনেকের মাস্কই সঠিকভাবে পরা ছিল না।

কেএম/এসএসএইচ