কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ভাষায়- ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেনো ভাই, ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’

মা শব্দটি ছোট হলেও তার ভালোবাসার গভীরতা অসীম। একটি শিশুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা সব কিছুই সে পেয়ে থাকে মায়ের কাছ থেকে। মায়ের ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপ করা কিংবা শোধ করার ক্ষমতা কারও নেই।

শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোক্তার পাশাপাশি একজন মায়ের পরিচয় তিনি একজন গৃহিণী। পেশাগত কাজের পাশাপাশি তাকে পরিবারের পেছনেও সময় দিতে হয়। যা একজন পুরুষের চেয়ে কম নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশিই বটে। তেমনই একজন মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তার দায়িত্বও অনেক। তিনি একাধারে ঢাবির শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সদস্য, ঢাবি বিজ্ঞান সংসদের মডারেটর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত নতুন কারিকুলামের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ক বইয়ের লেখক, বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি, বাংলাদেশ ওমেন ইন টেকনোলজির সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্লাইং ল্যাবসের সভাপতি, বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি এবং ইন্টারন্যাশনাল রোবট অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

মা দিবস উপলক্ষে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

ঢাকা পোস্ট : আপনার জন্ম কবে, কোথায়?

লাফিফা জামাল : আমার জন্ম ১৯৭৬ সালে নারায়ণগঞ্জে।

ঢাকা পোস্ট : স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন কোন কোন প্রতিষ্ঠানে?

লাফিফা জামাল: নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরি স্কুলে আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। সেখানে আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলে পড়েছি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করি। পরবর্তী সময়ে একই বিভাগ হয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করি। পরে রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করি। বর্তমানে এ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছি।

ঢাকা পোস্ট : ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?

লাফিফা জামাল : ছোটবেলায় তো অতকিছু বুঝতাম না। মনে হতো পাইলট হব, প্লেন চালাব। এইচএসসির পরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, দিল্লি (আইআইটি) এ অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু মা তখন একমাত্র সন্তান হওয়ায় দেশের বাইরে পড়তে দিতে চায়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা ছিল। সে কারণে বুয়েটে ভর্তি হই। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তির সুযোগ পেয়ে সেখানে চলে আসি। আমরা এই বিভাগের অনার্স প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। শিক্ষকতা পেশায় পরিকল্পনা থেকে আসা হয়নি। তবে, ভালো লাগা ছিল এ পেশার প্রতি।

ঢাকা পোস্ট : আপনার সন্তানেরা কে কোথায় পড়াশোনা করছে?

লাফিফা জামাল : আমার ছেলে-মেয়ে দুজন। ছেলে বড়, নাম শ্রেষ্ঠ; মেয়ে ছোট, নাম শ্রেয়সী। তারা দুজনই সানবিমস স্কুলে পড়ে। ছেলের বয়স ১৯ বছর, ‘ও’-‘এ’ লেভেলের পরীক্ষার্থী। আর মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে, ওর বয়স ১৬ বছর। 

ঢাকা পোস্ট : শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সংসার কিভাবে সামলান?

লাফিফা জামাল : আমি শুধুমাত্র শিক্ষকতা নয়, বাইরের অনেক বিষয়ের সঙ্গেও যুক্ত। এসবের পাশাপাশি তো সংসারে সময় দিতেই হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বলি, সেটা আরেকটু কঠিন। তারপরও টাইম ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখার চেষ্টা করি। আমার দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। সকাল আটটা পর্যন্ত সংসারের কাজে সময় দেই। এরপর নিজের কাজে যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত হয়।

আমার সন্তানেরা খু্বই সাপোর্টিভ। একদিন ছেলে বিকেলের নাস্তা বানায় তো আরেকদিন মেয়ে। চেষ্টা করি ওদের শেখানোর। এখন তো আর ছেলে-মেয়ে আলাদা বলে কিছু নাই। বাচ্চারা এখন বড় হয়েছে। তাদের পড়াশোনার পেছনে এখন খুব একটা সময় না দিলেও চলে। দুজনের কারো জন্যই নবম শ্রেণি পর্যন্ত গৃহশিক্ষক রাখিনি। স্কুলের পর বাসায় নিজে পড়িয়েছি। আমি মনে করি, ডেডিকেশন আর পরিবারের সহযোগিতা থাকলে এটা সম্ভব।

একটা সময় ছিল পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রচুর বই পড়তাম। গান শুনতে খুবই পছন্দ করতাম, মন দিয়ে গান শোনা যেটাকে বলে। এখন আর সেভাবে সময় পাই না। তারপরেও সময় পেলে শুনি। অভ্যাস রয়ে গেছে। রাতের বেলা এত ক্লান্ত থাকি যে খানিকটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। এখন তো হলের দায়িত্ব আছে, শিক্ষক সমিতিতে আছি, রোবটিক্স কার্যক্রমের জন্যও অনেক সময় দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবং গবেষণায়ও একটা লম্বা সময় দিতে হয়। তাই দিন দিন ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। দিনশেষে নিজের জন্য আর কোনো সময় থাকে না।

ঢাকা পোস্ট : আপনার সারাদিন কীভাবে অতিবাহিত হয়?

লাফিফা জামাল : খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে এক কাপ কফি বা চা খেতে খেতে গান শুনি। তারপর বাসার কাজগুলো গুছিয়ে রাখি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কোলাবোরেশানে কাজ করি। সকাল-সকাল জরুরি ইমেইলগুলোর জবাব দিতে হয়। এরপর সকাল-বেলা ডিপার্টমেন্টে ক্লাস থাকে, গবেষণার কাজ থাকে, হলে কাজ থাকে। সেখানে সময় দেই। অন্যান্য যেসব সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, বিকেলের দিকে সেখানে সময় দেই। আইসিটি ডিভিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। এখন সপ্তম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি বই লেখার কাজ করছি। লেখালেখির কাজ সাধারণত রাতের বেলা বাসায় ফিরে করি। আবার ভোরবেলাও করি কোনো কোনো দিন। 

ঢাকা পোস্ট : ছুটির দিনে কি করেন?

লাফিফা জামাল : সাপ্তাহিক ছুটি তো দুই দিন, চেষ্টা করি শুক্রবারে কোনো কাজ না রাখতে। এ দিনটা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করি। শনিবারে এটা হয়ে ওঠে না। কোনো না কোনো কাজ পড়ে যায়। আর সরকারি ছুটির দিনে ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘুরতে বের হই। 

ঢাকা পোস্ট : পেশাগত জীবনে শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা?

লাফিফা জামাল : ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা বা পেশাগতকাজে কোনো বাধা পাইনি। এটা সাধারণত আমাদের দেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের কাজ করার বেলায় শ্বশুরবাড়ির নিষেধাজ্ঞা থাকে। তবে সে জায়গা থেকে আমি ভাগ্যবতী। বিয়ের দিনই শাশুড়ির মুখ থেকে শুনেছি, তার ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়ে পিএইচডি করবে। তারা পারেনি। আমি যেন তার স্বপ্নটা পূরণ করি। বাসার কাজ নিয়ে আমাকে একদমই চিন্তা না করতে বলতেন তিনি। আমাকে সবসময় ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার পরামর্শ দিতেন। এই সহযোগিতাটা খুব দরকার, যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সচরাচর দেখা যায় না। এখন পেশাগত কারণে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকি। কিন্তু তারপরও তারা আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। সহযোগিতা করতে না পারলেও কোনো ক্ষেত্রে বাধা দেননি।

ঢাকা পোস্ট : বিবাহিত পেশাজীবী নারী বা মায়েদের প্রতি আপনার বার্তা কি থাকবে?

লাফিফা জামাল : একটা কথাই বলব, আমি নিজেকে কোনো জায়গায় দেখতে চাই, তার স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে হবে। চলার পথে বাধা আসবেই। সেই বাধাকে সবসময় সরিয়ে রাখা যায় না। মনোবল অটুট থাকলে আমরা সেই বাধাকে অতিক্রম করতে পারব। পরিবারের সবার সহযোগিতা পেলেও এমন নয় যে, কখনো কোনো বাধা পাইনি। আমি এটাকে জীবনের একটা অংশ ধরে নিয়েছি। স্বপ্ন পূরণের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে। পারিবারিক বা অন্য কোনো কারণে আমরা যেন হতোদ্যম হয়ে আশা ছেড়ে না দেই।

ঢাকা পোস্ট : আপনাকে ধন্যবাদ।

লাফিফা জামাল : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।

এএজে/এসএম