বয়স মাত্র তিন মাস, এখনো ফোটেনি মুখের কথা। মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র ভাষা তার কান্না। অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত শরীরের যন্ত্রণা কতটুকুই বা নিতে পারে! নিষ্পাপ এ শিশুর তীব্র যন্ত্রণা কষ্ট দিচ্ছে বাবা-মাসহ আত্মীয় স্বজনদের। নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার নেই তাদের।

দুর্বৃত্তদের ছোড়া অ্যাসিডে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে থাকা এ শিশুর নাম সূর্য। তার বিরামহীন কান্নায় চোখ ভিজে আসছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের অন্য রোগী ও স্বজনদেরও। 

মঙ্গলবার (১০ মে) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, শিশু সূর্যের মুখমণ্ডল ও দুই হাত অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছে। বাদ যায়নি শিশুটির ডান চোখও। দুই হাতের কনুইয়ের নিচের অংশেও পোড়া ক্ষত সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা। মুখের ভেতর আর মাথার সামনের অংশও পুড়েছে অনেকটা। শরীরের পোড়া চামড়ার কোন অংশে যন্ত্রণা কেমন তা বোঝানোর ক্ষমতা কিংবা বয়স কোনোটিই হয়নি তার। ছোট শরীরে তীব্র যন্ত্রণার ধকল সইতে না পেরে সারাক্ষণই কাঁদছে সে। সন্তানের এমন কষ্ট দেখে বারবার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন মা বীণা কর্মকার। পাশে বসে নাতির ছটফটানি আর অস্থিরতা দেখে স্তব্ধ দাদি দীপালি কর্মকার। নির্বাক সূর্যের বাবা-চাচাও।

ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সূর্যের মা বীণা কর্মকার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতের খাবার খেয়ে আমি ও আমার শাশুড়ি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার স্বামী ও দেবর পাশের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে জানালা দিয়ে তরল জাতীয় কিছু আমাদের শরীরে ছুড়ে মারে কেউ। মুহূর্তে আমাদের শরীরে জ্বলতে শুরু করে। আমার ছোট শিশুটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। পরে আশপাশের লোকজন চিৎকার শুনে এসে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য রেফার করা হয়। 

তিনি আরও বলেন, আমার এই অবুঝ শিশুটির কী দোষ ছিল? আমরা তো কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করিনি। আমাদের তো কোনো শত্রু নেই। তাহলে কেন আমাদের শরীরে অ্যাসিড ছুড়ে মারল? আমার এ অবুঝ শিশুটি কার ক্ষতি করেছিল আজ সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। ডান চোখটাও হারাতে বসেছে।

শিশু সূর্যের দাদি দীপালি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সূর্যের জন্মের পর থেকে রাতে এক রুমে থাকি আমিও আমার পুত্রবধূ বীণা। সূর্যের বাবা ও চাচা পাশের রুমে ঘুমায়। সূর্য থাকে মাঝখানে। ঘরের পশ্চিম পাশে খাট রাখা। পূর্ব পাশের জানালা থেকে বেশ দূরত্বে খাট। জানালার পাশে রাস্তা। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমানোর আগে কাঠের জানালায় ছিটকিনি দেওয়া হয়। পরে জানালার ফাঁক দিয়ে আমাদের উপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

সূর্যের বাবা সাগর কর্মকার বলেন, আমাদের এলাকায় আমার জানামতে কোনো শত্রু নেই। কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে সেটা বলতে পারছি না। মামলা দায়ের হয়েছে। সন্দেহজনক একজনকে আটক করেছে পুলিশ।

শিশু সূর্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. এস এম আইয়ুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৬ মে (শুক্রবার) বিকেলের দিকে ওই শিশুকে আমাদের এখানে আনা হয়। সূর্যের শরীরের ১০ শতাংশ কেমিক্যালে দগ্ধ হয়েছে। তার মুখমণ্ডল ও দুই হাত দগ্ধ হয়েছে। তার ডান চোখ প্রায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এখন আমরা চিকিৎসা দেওয়ার পর তার চোখ কিছুটা ভালো হয়েছে। আমরা ধারণা করছি ওই চোখ দিয়ে সে দেখতে পারছে। শিশুটির যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে এখানে কমপক্ষে ১ মাস চিকিৎসা নিতে হবে। তবে তার মুখমণ্ডল আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না। যদিও শিশুটি ১০ শতাংশ কেমিক্যালে দগ্ধ হয়েছে, কিন্তু ক্ষতটা অনেক গভীর। তাই সুস্থ হতে সময় লাগবে।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (৬ মে) ভোরে বগুড়ার গাবতলীর তেলেহাটি গ্রামে ঘরের জানালা দিয়ে অ্যাসিড ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে বীণা কর্মকার ও তার শাশুড়ি দীপালি দগ্ধ হন। দুজনের মাঝে থাকা শিশু সূর্যও এই ঘটনায় দগ্ধ হয়। ঘটনার পর তাদের বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় শিশু সূর্যকে ঢাকায় স্থানান্তরের পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। শুক্রবার সন্ধ্যায় শিশুসহ তিনজনই রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।

এসএএ/এসকেডি