বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে মূলত ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি সার বেশি ব্যবহৃত হয়। ছবি : সংগৃহীত

২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকির আওতায় বেসরকারি পর্যায়ের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ টন সার (নন-ইউরিয়া) আমদানি করা হবে। এজন্য ইতোমধ্যে আমদানিকারকদের কাছে প্রস্তাব আহ্বান করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। আগামী ৯ জুন প্রস্তাব জমা দিতে হবে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা থেকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি দিয়ে এ প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে। 

চিঠির তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকির আওতায় বেসরকারি পর্যায়ের মাধ্যমে কম-বেশি প্রায় আড়াই লাখ টন টিএসপি, ৭ লাখ টন ডিএপি সার, ৩২ হাজার টন পাউডার এমএপি এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ এমওপি সার সংগ্রহ করা হবে। তবে প্রয়োজনে এ পরিমাণ আরও কম-বেশি হতে পারে। 

সার আমদানির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে আমদানিকারকদের। চিঠিতে বলা হয়, বেসরকারি পর্যায়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার আমদানির লক্ষ্যে বিভিন্ন নির্দেশনা অনুসরণ করে  আমদানিকারকদের (নিজস্ব প্যাডে) কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করা যাচ্ছে।

আমদানির জন্য নির্দেশনা
বেসরকারি পর্যায়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার আমদানির লক্ষ্যে আগামী ৯ জুন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে সিলগালা করা খামে প্রস্তাব জমা দিতে হবে। খামের উপর সারের নাম উল্লেখ করতে হবে। খামে প্রস্তাবগুলো সচিবালয়ের ৪নং ভবনের ৫০৮ নম্বর কক্ষে থাকা নির্ধারিত বাক্সে অথবা বিএডিসির সদস্য-পরিচালকের (সার ব্যবস্থাপনা বিভাগ) দপ্তরে থাকা বাক্সে জমা দিতে হবে।  

একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান একটি মাত্র প্রস্তাব জমা দিতে পারবে। একটি প্রস্তাবে একাধিক দর উল্লেখ থাকলে প্রস্তাব বাতিল বলে গণ্য হবে। তাছাড়া শর্তযুক্ত প্রস্তাবও বাতিল বলে গণ্য হবে। 

নির্ধারিত কোটার সারের চাহিদা পূরণের জন্য শেষদিকে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ সারের জন্য একাধিক প্রস্তাবকের দর একই হলে একইহারে বণ্টনের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা যাবে। চূড়ান্ত মনোনয়ন/কার্যাদেশ জারির পর ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে আমদানিকারকদের ঋণপত্র স্থাপন করে জামানতের অর্থসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে।

হিসাবের সুবিধার্থে ভর্তুকি বিল দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতায়িত মুদ্রার বিনিময় হার (মার্কিন ডলার/টাকা) জমা দিতে হবে। এ প্রত্যায়িত বিনিময় হারের ফলে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের কোনো ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক স্ব-উদ্যোগে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করাসহ অতিরিক্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে সার আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক সুদ হার ৮ শতাংশ, স্থানীয় ব্যয় টন প্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং মুনাফা ৩ শতাংশ আগের মতো বলবৎ থাকবে। 

নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ঋণপত্র স্থাপনে ব্যর্থ হলে প্রস্তাবের সাথে জামানতবাবদ জমা দেওয়া সমুদয় অর্থ বাজেয়াপ্তসহ মনোনয়ন বাতিল মর্মে গণ্য হবে এবং তালিকার পরবর্তী দরদাতাকে সার সরবরাহের জন্য প্রস্তাব করা যাবে। তবে এ সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। 

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিএপি সারের প্রতি প্রস্তাবে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন এবং অন্যান্য (টিএসপি, এমওপি এবং পাউডার এসপি) সারের প্রতি প্রস্তাবে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টন সারের জন্য প্রস্তাব জমা দিতে পারবে। 

যে মূল্যেই বাংলাদেশে সার আমদানি করা হোক না কেন, সেখানে ভর্তুকি যোগ করে সরকার কৃষকের কাছে নামমাত্র মূল্যে সার বিক্রি করে থাকে। ছবি : সংগৃহীত

সার জাহাজীকরণের সর্বশেষ সময়সীমা ১৫ সেপ্টেম্বর। ফোর্স ম্যাজিউর ছাড়া অন্য কোনো কারণে জাহাজীকরণের সময় বৃদ্ধিতে জরিমানা আরোপের এখতিয়ার মন্ত্রণালয় সংরক্ষণ করে।

বেসরকারি সার আমদানিকারকরা আমদানি করা সার বিভিন্ন মোকামে (চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ নগরবাড়ী ও নোয়াপাড়া) সংরক্ষণ করবেন। মোট আমদানি করা সারের মধ্যে চট্টগ্রামে (সম্ভাব্য) ৩%, নারায়ণগঞ্জে (সম্ভাব্য) ৩০%, নগরবাড়ীতে (সম্ভাব্য) ৩৫% এবং নোয়াপাড়ায় (সম্ভাব্য) ৩২% সংরক্ষণ করতে হবে। সার সংরক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করতে হবে। এসব মোকাম ছাড়া অন্য কোনো মোকামে সার সংরক্ষণ করতে হলে বা এসব মোকামে মজুদের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকসহ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এবং কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে।

আমদানি করা সার ডিলার পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শর্ত আরোপ বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সার সরবরাহের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করা যাবে না। কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে মোকাম সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকরা আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করতে পারবেন।

নন-ইউরিয়া সার আমদানি, বিক্রয় এবং ভর্তুকির পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্র অনুসারে আমদানিকারকদের প্রস্তাবের সাথে সারের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে ম্যানুফ্যাকচার সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। ম্যানুফেকচার সার্টিফিকেটে সারের নির্দেশসহ সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরবরাহে সম্মত মর্মে উল্লেখ থাকতে হবে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখার উপ-প্রধান শেখ বদিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রায় ১০ লাখ টনের মতো নন-ইউরিয়া সার বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা হবে। এজন্য আমরা প্রস্তাব আহ্বান করেছি।  

গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও সারের চাহিদার প্রায় সবটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তবে যে মূল্যেই আমদানি করা হোক না কেন, সেখানে ভর্তুকি যোগ করে সরকার কৃষকের কাছে নামমাত্র মূল্যে সার বিক্রি করে থাকে। কিন্তু গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে।

প্রস্তাব পাওয়ার পর আমদানিকারক বাছাই করা হবে বলেও জানান তিনি। শেখ বদিউল বলেন, সব আমদানিকদেরকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। ধরুন আমরা ৭ লাখ টনের জন্য প্রস্তাব আহ্বান করলাম। আমরা সেক্ষেত্রে কোনো কোনো সময়ে ১৫ লাখ টনের প্রস্তাব পাই। দামের ওপরে এটা নির্ভর করে। 

তিনি বলেন, আগামী ৯ জুন প্রস্তাব জমা দিতে পারবে। ৯ তারিখের পর আমরা কী পরিমাণ প্রস্তাব পেলাম, সে প্রেক্ষিতে অনুমোদন দেওয়া হবে। এরপর তারা কে কতটুকু আনল, তা মূল বিষয়। যদি প্রয়োজন হয় আবার প্রস্তাব আহ্বান করা হবে। 

সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখার উপ-প্রধান আরও বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় সারা বছরই আমদানি হয়ে থাকে। প্রতি মাসেই শিডিউল অনুসারে আমদানি হয়। 

জানা গেছে, নন-ইউরিয়া সারের ৬০ শতাংশ সরকার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে আমদানি করে ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত করে। ৪০ শতাংশ সার ভর্তুকির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে আমদাানি করা হয়, যা পরবর্তীতে ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) বলাই কৃষ্ণ হাজরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম মেনে আমদানিকারকদেরকে সার আমদানি করতে হবে। 

অনেক দেশে সারের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, তারা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে বা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে যোগানের তুলনায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। ছবি : সংগৃহীত

ইউরিয়া সার গাছের বৃদ্ধি বাড়ায়। টিএসপি ও ডিএপি গাছের কাণ্ড শক্তিশালী করে ও ফসল উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়য়ে দেয়, এমওপি গাছের দৃঢ়তা বাড়িয়ে তোলে।

কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশে বরাবরই কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। গত অর্থ বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে সারের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এজন্য সরকারের ভর্তুকিও বেড়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে ৯ হাজার কোটি টাকা করে সারে ভর্তুকি দিয়ে এলেও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি কেজি টিএসপি আমদানিতে ব্যয় হয় ৭০ টাকা, এমওপি ৫৪ টাকা ও ডিএপিতে খরচ হয় ৯৩ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি টিএসপি সারের আমদানি মূল্য ছিল ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা, ডিএপি ৩৭ টাকা।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর সরকার সারে ভর্তুকি দিচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। 

২০২২-২৩ সালের বাজেটে কৃষিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এসএইচআর/এনএফ