সব পাবলিক প্লেস ও ট্রান্সপোর্ট শতভাগ ধূমপান মুক্ত করা এবং ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থানের অনুমতি দেওয়ার যেকোনো বিধান অপসারণসহ ৬ দফা দাবিতে শেষ হলো সংসদ সদস্যদের ৩ দিনব্যাপী তামাক বিরোধী সম্মেলন।

শুক্রবার (২০ মে) বেলা সাড়ে ১১টায় কক্সবাজারের সি পার্ল রিসোর্টে বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং আয়োজিত ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনের সমাপনী দিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিংয়ের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত।

এমপি সম্মেলনের অন্যান্য দাবিগুলো হলো, তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সব কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচী নিষিদ্ধ করা, একক শলাকা সিগারেট, প্যাকেটবিহীন তামাক বা ছোট প্যাকেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা, সব তামাকজাত দ্রব্যের উপর সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার প্যাকেটের সামনে এবং পিছনের পৃষ্ঠের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা এবং ই-সিগারেট, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট, ওরাল নিকোটিন পাউচ এবং অন্যান্য ইমার্জিং টোব্যাকো ও নিকোটিন পণ্যের আমদানি, রপ্তানি উৎপাদন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় এবং বাজারজাতকরণের উপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা থাকা।

সংবাদ সম্মেলন থেকে লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন যে, ৪২ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক এখনও কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় এবং ৫৯ শতাংশ যুবক পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বাংলাদেশের সমাজ এবং নাগরিকদের উপর তামাকের কারণে সৃষ্ট অব্যাহত স্বাস্থ্যের ক্ষতির বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ ২০১৮ সালের হিসেব অনুসারে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যাচ্ছেন। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে আক্রান্ত এবং প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে রোগে ভুগছে। বাংলাদেশে তামাকের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়েও আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কেননা শুধুমাত্র ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় প্রায় ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এবং তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুর কারণে প্রায় ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থের উৎপাদনশীলতা হারিয়েছে।

তিনি বলেন, ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এবং ২০১৫ এর ফলে আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখতে পাই। ২০০৯ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা নেমে এসেছে ৩৫.৩ শতাংশে। তবে আমরা উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণের মূল নীতিসমূহ এবং বৈশ্বিক উদাহরণসমূহ বাস্তবায়নে আঞ্চলিক এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে।

ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত আরও বলেন, পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি এবং পরোক্ষ ধূমপান থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা’র স্থান অকার্যকরিতার সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে অফিস ভবনসহ অনেক পাবলিক প্লেসে, নির্দিষ্ট গণপরিবহনে এবং নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো বিক্রয়স্থলে পণ্য প্রদর্শন এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের প্রাণঘাতী পণ্যের প্রচার-প্রচারণার সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি, আকর্ষণীয় মোড়কে ব্র্যান্ডিং এবং একক শলাকা সিগারেট বা প্যাকেটবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির মাধ্যমে তরুণদের তামাক ব্যবহারে আকৃষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ই-সিগারেট, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট এবং ওরান নিকোটিন পাউচসহ ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস এবং নিকোটিন পণ্যের বিক্রি ব্যাপক বৃদ্ধি এবং অনেক দেশে যুবকদের এই জাতীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণে আমরা শঙ্কিত। বাংলাদেশে তামাক ও নিকোটিন দ্রব্যের বাজার তৈরি এবং বাংলাদেশি যুবকদের কাছে এই পণ্যগুলোর প্রচার নিয়ে আমরা শঙ্কিত। এই পণ্যগুলো বাংলাদেশের বর্তমান আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। তাই আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি এবং এর নির্দেশিকাসমূহ বাস্তবায়নে চাহিদা ও যোগান হ্রাস নীতি এবং সেই চুক্তির সাধারণ বাধ্যবাধকতাগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়নসহ, সর্বোচ্চ স্তরে পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করছি। বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ৫.৩ এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোকে তামাক কোম্পানিগুলোকে বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সুযোগ না দেওয়ার বাধ্যবাধকতার উপর জোর দিচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা সব স্টেকহোল্ডারদের চিকিৎসক (স্বাস্থ্যসেবী), শিক্ষাবিদ, রোগী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদার, সংস্থা এবং তহবিল যোগানদাতা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, ধর্মীয় সংস্থাসমূহ এবং অন্যান্যদের এই জাতীয় নীতিগুলোর সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করার জন্য এবং তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং সব স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সংহতি ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এই ঘোষণা বাস্তবায়নে কাজ করব এবং অন্যদের এই ঘোষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমর্থন করতে উৎসাহিত করব। কাউকে বাদ না দিয়ে আমরা একসঙ্গে অবিরাম প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে পারি এবং করব এবং আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

সংবাদ সম্মেলন আরও উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আ.ফ.ম রুহুল হক, ড. মো. আব্দুস শহীদ, আ.স.ম ফিরোজ, মো. শহীদুজ্জামান সরকার, রওশন আরা মান্নান, শিরীন আখতার, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। এছাড়া সম্মেলন আসা সব সংসদ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

এমএইচএন/আইএসএইচ