মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আলোচিত উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান এবং একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের ছেলে মো. শরীফ মোস্তাক ৬ বছর আগে ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন।

অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের ছেলে শরীফ মোস্তাক কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আতিকুর রহমানের স্ত্রী নাহিদা ইসলাম নিপা কোম্পানির পরিচালক। যদিও চেয়ারম্যান মোস্তাক সম্প্রতি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি এমডি আতিকুরের। রাজধানীর বনশ্রী ও আফতাব নগরে এই কোম্পানির বেশ কয়েকটি প্রজেক্টের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তিবাণিজ্য, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা ও সংস্কারকাজ করাসহ বিভিন্ন খাত থেকে নানা উপায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে। ওই অভিযোগের সঙ্গে ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি গঠন ও কার্যক্রমে দুর্নীতির যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করছে দুদক। এক্ষেত্রে আইডিয়ালের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের ছেলে মো. শরীফ মোস্তাক বড় ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। 

প্রায় একই ধরনের অভিযোগে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের বিরুদ্ধে আরও একটি অনুসন্ধান চলমান রয়েছে, যার সঙ্গে এর যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এসব কারণে অনুসন্ধানের স্বার্থে আলোচিত উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান, তার স্ত্রী নাহিদা ইসলাম নিপা এবং আইডিয়ালের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের ছেলে শরীফ মোস্তাককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক। 

সংস্থাটির ১৬ মে দেওয়া তলবি নোটিশে আতিকুর রহমান খানকে এবার ব্যবসায়ী পরিচয়ে তলব করা হয়েছে।

চিঠিতে তাদের আগামী ২৫ মে (বুধবার) দুদকে সশরীরে হাজির হয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন অনুসন্ধান টিম প্রধান দুদক পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ভূঁইয়া। দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চিঠিতে তাদের আগামী ২৫ মে (বুধবার) দুদকে সশরীরে হাজির হয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন অনুসন্ধান টিম প্রধান দুদক পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ভূঁইয়া। দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তলবি নোটিশ ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিয়ালের আলোচিত উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের চিঠি এখনো হাতে পাইনি। ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড কোম্পানির বয়স ৬ বছর। আমি কোম্পানির ফাউন্ডার এমডি। শরীফ মোস্তাক একসময় চেয়ারম্যান ছিলেন, এখন নেই। বর্তমানে আমার নেতৃত্বে কর্মকাণ্ড চলছে। আফতাব নগরে বেশকিছু কাজ করেছি, এখনো কিছু কাজ চলছে।

তিনি বলেন, ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড আমার প্রতিষ্ঠান। এটা অস্বীকার করছি না। তবে আমি ঋণ নিয়ে কাজ করছি। ব্যবসা করা কোনো অপরাধ নয়। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। ব্যবসার মাধ্যমে আমি একটা অবস্থান তৈরি করেছি। এ বিষয়টি অনেকের ভালো লাগছে না।

ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে আতিক বলেন, আমাকে বলা হচ্ছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অথচ আমি প্রশাসনিক কর্মকর্তা নই। ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। দুদক পুরো তালিকা নিয়েছে, সেখানে আমার কোনো রেফারেন্স পায়নি। কোনো কাগজপত্রে আমার সই নেই। তাহলে কীভাবে ভর্তি বাণিজ্য করলাম? আয়কর নথিতে যে সম্পদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটাই আমার সম্পদ। এর বাইরে কোনো সম্পদ নেই।

দুদকের চিঠি এবং অভিযোগের বিষয়ে জানতে আইডিয়ালের অধ্যক্ষ শাহান আরার ছেলে শরীফ মোস্তাকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ঢাকা পোস্ট। তবে অনেকবার ডায়াল করেও তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। 

এ বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আতিকুর রহমানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ‘ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানির খোঁজ পায়। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোম্পানিটির সঙ্গে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের ছেলে শরীফ মোস্তাক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান ও তার স্ত্রী নিপার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। কীভাবে কোম্পানিটি চলছে, এর মূলধন কোথা থেকে এল, ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ে আর্থিক লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে হয়েছে কি না এবং কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র যথাযথ রয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানতেই তাদের তলব করা হয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে প্রথমবারের মতো আতিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তখন গণমাধ্যমে নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে আতিকুর বলেছিলেন, আমি কৃষকের ছেলে, আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। ভর্তি বাণিজ্যের যে অভিযোগের কথা বলছেন সেটা আমি করি না। অন্য কেউ করে থাকতে পারে। আমি চুক্তিভিত্তিক চাকরি করি।

ওই বছরের ৮ আগস্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০২১ সালের ৩ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

আতিকুর রহমান খান ২০০৪ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এমপিওভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কোনো পদ নেই। অবৈধভাবে এ পদ সৃষ্টি করে অধ্যক্ষ শাহান আরা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে দেশের ১৫টি ব্যাংকে আতিকুর রহমানের ৯৭টি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ১১০ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা লেনদেন হয়েছে

এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে দেশের ১৫টি ব্যাংকে আতিকুর রহমানের ৯৭টি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ১১০ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা লেনদেন হয়েছে।

দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অবৈধ ভর্তিসহ সব বাণিজ্যের হোতা আতিকুর রহমান। তিনটি ক্যাম্পাসের প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ড্রেস তৈরি, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি সবই তার নিয়ন্ত্রণে। এমনকি স্কুলের সামনে ফুটপাতে শতাধিক দোকান বসিয়েও তিনি আয় করেন মোটা অংকের টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে যত ধরনের কেনাকাটা, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ হয়, তার সবই করেন আতিক ও তার লোকেরা। দরপত্রেও অংশ নেয় নামে-বেনামে তারই প্রতিষ্ঠান। সেখানে চলে বড় ধরনের লুটপাট। গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী নিয়োগে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের দুর্নীতি

ভর্তি বাণিজ্য ও ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আতাউর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক আফনান কেয়া তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন গণমাধ্যমে অধ্যক্ষ শাহান আরা বলেছিলেন, এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই; নীতি বর্হিভূত কোনো কাজ হয়নি। ভর্তি বাণিজ্যের বিষয়টি আমার জানা নেই। গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত অনুসারে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছে। কেউ বাণিজ্য করে থাকলে আমার জানার কথা নয়।

তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের যোগসাজশে শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। ২০১৯ সালে মতিঝিল শাখায় এসএসসি ফরম পূরণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। টেস্ট পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হন তাদের কাছ থেকে সাবজেক্টপ্রতি ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করে ফরম পূরণের সুযোগ দেন অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। এভাবে দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। 

২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘বিশেষ ক্লাসের’ নামে বাধ্যতামূলক অর্থ আদায়ের অভিযোগ পেয়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখায় অভিযান চালায় দুদকের একটি দল। তারা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পান।

আরএম/এসএম