পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তকারী বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের চিফ প্রসিকিউটর লুই মোরানো ওকাম্পো ফরমান পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি করার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।

বুধবার একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনা সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, দুঃখের মধ্যেও সূর্য ওঠে। অন্ধকারেও আলোর পথ দেখা যায়। সে রকমই আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি তার পরিবারের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন পদ্মা সেতু।  

তিনি বলেন, এ পদ্মা সেতু কীভাবে হলো, কখন হলো সেগুলো নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বিস্তারিত বলবেন। আজ আমি শুধু এটুকু বলব, এ পদ্মা সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথটা মসৃণ ছিল না, ছিল বন্ধুর। প্রথম যখন পদ্মা সেতু তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয় তখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আরও কিছু সংস্থা সেতুর অর্থায়নে সম্মতি দিয়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, সেসময় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলন হয়েছিল। তার মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিতে চেয়েছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে হঠাৎ একদিন বিশ্বব্যাংক বলে উঠল পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে এবং তারা এই দুর্নীতির তদন্ত চায়। তদন্তের কথা বলার পরই বিশ্বব্যাংক বলল, তারা পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।

তিনি বলেন, আমি তখন দুদকের চিফ কাউন্সিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা দুদকের সঙ্গে বসে বলল, এ দুর্নীতির তদন্ত হতে হবে। দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, দুদক কমিশনার বদিউজ্জামান, শাহাবুদ্দিন চুপ্পু এবং আমি গোলাম রহমানের গুলশানের বাসায় তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম।

আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিশ্বব্যাংকের চাহিদা মোতাবেক তাদেরকে সব দিয়ে দেওয়া হোক- এ রকম নির্দেশও আমাদেরকে দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে  প্রধানমন্ত্রীর সবসময় যোগাযোগ ছিল। সেই কারণে আমার সৌভাগ্য হয় তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করার। তিনি আমাকে সেদিন বলেছিলেন, আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন, আমরা স্বাধীনতা কারো হাতে তুলে দেব না।

তিনি বলেন, কী কারণে এ কথা? বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি বিভাগের প্রধান দাবি করলেন বিশ্বব্যাংক নিজেই এ মামলার তদন্ত করবে। আগে যাদের নাম উল্লেখ করেছি তারা সাক্ষী। আমি তখন তাদের (বিশ্বব্যাংক) বললাম, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, আমাদের আইনে তোমাদের তদন্ত করার কোনো বিধান নেই। তোমরা তদন্ত করলে মামলা চলবে না। তখন তারা বলল, তাহলে কী হবে? আমি বললাম, দুর্নীতির মামলা হবে, তদন্ত করব আমরা। কিন্তু দুর্নীতির কথা যেহেতু তোমরা তুলেছ, তোমাদের একটি টিম তৈরি করে দাও যারা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজো করবে এবং এ তদন্তের  বিষয়ে তোমাদের অবহিত করবে। ২০১২ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখ বিশ্বব্যাংক তিন সদস্যের একটি প্যানেল ঘোষণা করল।

আইনমন্ত্রী বলেন, প্যানেলের সদস্য ছিলেন লুই মোরানো ওকাম্পো, ফরমার চিফ প্রসিকিউটর অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট। এখানে বলে রাখা ভালো, পরে তিনি দুর্নীতি করে অভিযুক্ত হয়ে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন।  আরেকজন হলেন, তিনো টিম টং, ফরমার কমিশনার অব ইন্ডিপেনডেন্টস করাপশন হংকং স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, এডমিনিস্ট্রেটিভ রিজন, পিপলস রিপাবলিক অব চীন। আরেকজন ওল্ডার ম্যান, ফরমার ডিরেক্টর অব ব্রিটেন সিরিয়াস ফ্রড অফিস।

মন্ত্রী বলেন, দুদক সুইমটো ডিসেম্বর মাসে একটি এফআইআর করল। এ  বিশ্বব্যাংক প্যানেল বাংলাদেশ সফরে এল। দুদকের চেয়ারম্যান, কমিশনার এবং আমার  সঙ্গে তাদের বৈঠক হলো। এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর ও বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ডিভিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বসলাম আমরা। বসার পরে তারা বললেন, তোমরা এফআইআর করেছো, ভালো। কিন্তু তৎকালীন যে যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেনর নামটা কেন দাওনি এ এফআইআরে? আমি তখন তাদের বললাম, তোমরা আমাদের দুটি  পৃষ্ঠা দিয়েছ। এ দুই পৃষ্ঠার মধ্যে যা আছে, এর বাইরে কি তোমাদের কাছে কোনো কাগজপত্র আছে? বললেন, না।

আনিসুল হক বলেন, আবুল হোসেনের অপরাধটা হচ্ছে যে, একটি চায়নিজ কোম্পানি তার সঙ্গে দেখা করেছে। এ পর্যন্তই ওই পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা আছে। এটিই তার অপরাধ। আমি তখন বললাম, এ রকম লোক তো আমার সঙ্গেও দেখা করে। তাহলে আমিও কি অপরাধী হয়ে যাব? তখন চুপ্পু (দুদক কমিশনার) আমার পাশে বসা। তিনিও আমাকে সমর্থন করেন।

এ সময় বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের প্রতিক্রিয়া নাটকীয় কায়দায় তুলে ধরে তিনি বলেন, ডু ইউ নো আবুল হোসেন? তিনি (চুপ্পু) তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। আমি বললাম, হু ডাজেন্ট নো এন মিনিস্টার? ইউ টেল মি, ডু ইউ নো হিম? আই সেইড, অফকোর্স আই নো হিম বাই নেম, বাট আই ডু নট নো হিম ইনডিভিজুয়ালি। তখন আই সেইড, হোয়াই ইউ আর ডুইং দিস? বলে, ইউ অ্যারেস্ট হিম অ্যান্ড টেক হিম রিমান্ড, ইউ উইল গেট এভরিথিং।

মন্ত্রী বলেন, আমি বললাম, নাথিং ডুইং। বলে তোমরা বলছো, কী অপরাধ হয়েছে? বলে ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি বললাম, ষড়যন্ত্রের অপরাধ তো প্রমাণ করতে হবে। ইনভেস্টিগেশনে যদি তার নাম আসে তাহলে আমরা দেব আসামী হিসেবে। এখন অপরাধের কথাটা বলি। এখানে প্রথমে আসামি করা হয়েছিল একজন সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে। তারপর আসামি করা হয় ব্রিজেস ডিভিশনের কয়েকজন অফিসার ও একজন ব্যবসায়ীকে। 

তিনি বলেন, মোশাররফ হোসেনের অপরাধটা কী? তিনি কানাডায় গিয়েছিলেন। তিনি কানাডায় যাওয়ার পর এসএমসি লাভালিন, যে কোম্পানিকে নিয়ে এসব ইতিহাস, এসব ষড়যন্ত্র। এই এসএমসি লাভালিন কোম্পানি হচ্ছে কানাডার একটা কোম্পানি। কানাডার কোম্পানিটি এ ব্রিজের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য টেন্ডারে পার্টিসিপেট করে। সেইখানে রমেশ নামে তাদের এক কর্মকর্তার ডায়েরির মধ্যে পাওয়া গেছে কে কে ওয়ান পার্সেন্ট, টু পার্সেন্ট, থ্রি পার্সেন্ট- এ রকম একটা। এই যে ডায়েরির মধ্যে লেখা, তাও পেন্সিলে লেখা। এ লেখাটাই হচ্ছে ষড়যন্ত্র। কিচ্ছু নাই। নাথিং, এটিই হলো ষড়যন্ত্র।

আনিসুল হক বলেন, তখন আমি বললাম, ষড়যন্ত্রের জন্য ১২০-বি আছে। এতে লেখা আছে শুধু ষড়যন্ত্রের জন্যও আপনার সাজা হতে পারে। ক্রাইমটা কমিটেড হওয়ার দরকার নাই, শুধু ষড়যন্ত্র হলেই। তখন বলে, তুমি তাহলে তাকে অ্যারেস্ট করো, রিমান্ডে দাও। আমি বললাম, নাথিং ডুইং। তারপরে হঠাৎ আমি শুনি যে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে কানাডিয়ান কোর্টে একটি হিয়ারিং হবে।

তিনি বলেন, আমার যতদূর মনে আছে, হয় ৪ এপ্রিল না হয় ১১ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল। এ বিষয়েই কানাডিয়ান কোর্টে তারা একটি মামলা করে দেয় এসএমসি লাভালিনের রমেশ বাবুর নামে। অন্য আরও আসামি ছিল।  আমাদের মামলার যে আসামি, তার নাম মোহাম্মদ মোস্তফা। তিনি  ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এটি হচ্ছে এসএমসি লাভালিনের লোকাল পার্টনার।

আনিসুল হক বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাদেরকে জিজ্ঞেস না করে গোপনে তাকে মোস্তফাকে বলেছে, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকায় তাকে সিটিজেনশিপ দেবে। তাকে আর জীবনে কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরতে হবে না। এ আশ্বাস দিয়ে তাকে বলেছে, রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য।  ফেব্রুয়ারি মাসে কানাডিয়ান কোর্টে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে,  যেটা আমরা বলি ১৬৪, সেকশন ১৬৪ এর জবানবন্দি। সে রকম দেওয়া হয়েছে। তারপরে কানাডিয়ান কোর্টে এর বিচার হয়েছে।

তিনি বলেন, এ বিচার হওয়ার পর আমি ২০১৩ সালের ২৯ মে কানাডায় যাই। কারণ সেখানে একটি ডেট ছিলো। ঠিক একঘণ্টা বাকি এয়ারপোর্টে যাওয়ার। তখনকার কানাডিয়ান হাইকমিশনার হেদার ক্রুডেট আমাকে ফোন করল। আমাকে ফোন করে বলছে, তুমি যে যাচ্ছ, তোমার সঙ্গে কিন্তু আমাদের কোনো লোক দেখা করবে না, ভালো কথা। তোমার চেহারা দেখবে না, ভালো কথা। তোমার কোনো টেলিফোন রিসিভ করবে না। তারপরেও আমি গেলাম।

মন্ত্রী বলেন, আমি যাওয়ার পর সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে কেউ কো-অপারেশন করেনি। আমাদের হাইকমিশনের একজন ফাস্ট সেক্রেটারি ছিলেন, নাম বলাই উচিত। তার নাম হচ্ছে বোধহয় রিফাত। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রিফাত আমাদের সঙ্গে তো কেউ কো-অপারেট করবে না। তো, এখন একটাই আমাদের উপায়। ৪ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত যে কোর্টের প্রসিডিংস হয়েছে , তার একটা সার্টিফায়েড কপি যদি আমরা পাই তাহলে খুব ভালো হয়। একটা দরখাস্ত দিয়ে দাও। তখন সে বলল, স্যার আমি একটি দরখাস্ত করে দিয়েছি।
 
তিনি বলেন, এ দরখাস্ত, এ সার্টিফাইড কপি আমাদের হাতে থাকার কারণে এ উইটনেসের স্টেটমেন্ট নিয়ে টেম্পারিং হয়নি। আমাদের তো জয় হবেই, এ জয় হয়েছিল। কানাডিয়ান কোর্ট বলে দিয়েছে, এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি।

আনিসুল হক বলেন, আমি শুধু বলতে চাই যে, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন যে আমরা নিজেদের অর্থায়নে এ পদ্মা সেতু করব অনেকেই কিন্তু হাসি-তামাশা করেছিল। আজকে এই বুক ভরা গর্ব নিয়ে, আনন্দ ভেজা চোখ নিয়ে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, তুমি পারো বঙ্গবন্ধু কন্যা, তুমি পারো পদ্মা সেতু বানাতে, তুমি পারো বাংলার আত্মমর্যাদা রাখতে।

এইউএ/আরএইচ