শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতার ভিত গরিব-নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ উল্লেখ করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ক্ষমতার পরিবর্তনের সামান্যতম সম্ভাবনা দেখলেই বড়লোক ও আমলাগোষ্ঠী মুহূর্তের মধ্যে রং বদলাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাই দেখা গিয়েছিল।

রোববার একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রের কর্তৃত্বভার এখন অতিক্ষুদ্র ধনিক গোষ্ঠী, সামরিক বেসামরিক আমলাদের হাতে বন্দী উল্লেখ করে মেনন বলেন, কোভিডকালে প্রধানমন্ত্রী সাহসিকতার সঙ্গে যে সকল প্রণোদনা দিয়েছেন তার কতখানি এরা বাস্তবায়িত করতে দিয়েছেন তার মূল্যায়ন হওয়া দরকার। সে সবের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যদের অতি অসম্মানজনকভাবে আমলাদের অধীন করা হয়েছিল। এই আমলা নিয়ন্ত্রণই রাজনীতিকদের দুর্বৃত্ত বলে বিবৃতি দিতে তাদের সাহস যোগায়।

কঠিন সময় অতিক্রম করছি জানিয়ে মেনন বলেন, কোভিডের অভিঘাত না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে, চলছে। আমেরিকা ইউরোপে তার নেতৃত্ব পুনর্বহাল করতে ন্যাটোর সম্প্রসারণ করার খেলায় মেতেছে। আর তাই ন্যাটো-রাশিয়ার ছায়া যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনে। কিন্তু প্রাচ্যেও যুদ্ধ তৈরির চেষ্টা চলছে। আমেরিকা ‘প্রাচ্যের ন্যাটো’ কোয়াড গঠন করেছে, অকাস গঠন করেছে, আইপিএফ-এর কাঠামো দিয়েছে। বাংলাদেশকেও তারা এসবের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। আর প্রাচ্যে এই যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশই অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হবে। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে তার কন্যা যে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখছেন তার থেকে নড়বেন না।

ইতোমধ্যেই ‘রেজিম চেঞ্জের’ খেলা শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মেনন। তিনি বলেন, মার্কিনীদের বন্ধুরা এমনভাবে কথা বলছেন যে খোদ স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের পেছনে রয়েছে। সাত দিনের মধ্যে সরকার ফেলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আমি বলি ষড়যন্ত্রের খেলা বন্ধ করুন। এটা ১৯৭৫ বা ২০০১ নয়। নিজের অর্থায়নে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু করেছে। এটা শেখ হাসিনার গৌরব, বাংলাদেশের গৌরব। তাকে হেয় করে, খাটো করে, তার দাবিদার সেজে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়া যাবে না। উন্নয়নশীল দেশের অভিধা নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে যাবে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। প্রধানমন্ত্রী এ লড়াইয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি ও চৌদ্দ দল আছে, থাকবে।
 
বাজেট প্রস্তাবে সংসদ প্রণীত আইনও বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি অর্থমন্ত্রী দাবি করে মেনন বলেন, সংসদ প্রণীত দুদক আইন ও মানি লন্ডারিং আইন দু’টোতেই অর্থ পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৯ পৃষ্ঠায় অর্থপাচার সম্পর্কিত উপ-শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে।
 
তিনি বলেন, দু’হাজার কোটি টাকার অর্থপাচারে অভিযুক্ত সাবেক স্থানীয় মন্ত্রীর ভাই খন্দকার মোহাতে মোনেম জামিনের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছে এটা এত বড় অপরাধ যে জামিনও দেওয়া যায় না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন অর্থপাচার সংঘবদ্ধ অপরাধ। নৈতিকতার কথা বাদ দিলাম। কারণ পুঁজি যেখানে লাভ দেখে সেখানে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেও রাজী। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেখানে সুখ আছে সেখানে টাকা যায়। তাই অর্থ পাচারকারীদের ৭ শতাংশ সুদ নিয়ে সেই সুখের সুলক সন্ধান দিলেন অর্থমন্ত্রী।
 
মেনন বলেন, অর্থমন্ত্রী সেদিন বলেছেন তিনি এটা করবেনই, মাঝপথ থেকে ফিরে আসার লোক তিনি নন। কেবল সংসদ দিয়ে তিনি এটাকে বৈধ করে নিতে চান।

মেনন বলেন, বাজেট আলোচনায় সংসদের ভূমিকা কার্যত ‘শোনাউল্লাহ’ আর ‘বকাউল্লাহ’র। আর শেষে ‘হ্যাঁ’ বলার। বাজেটের সঙ্গে সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের সংশ্লিষ্টতা নেই। ভারতের সংসদে বাজেট পেশের পর দু’থেকে চারদিন সাধারণ আলোচনার পর বাজেট বিভিন্ন স্থায়ী কমিটিতে চলে যায়। তার রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকারি দল-বিরোধী দল স্থীরকৃত মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ওপর আলোচনা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত বাজেট প্রণয়নের আগে সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। অর্থমন্ত্রী সেটাও তুলে দিয়েছেন।

বাজেট নিয়ে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের মতামত জাতীয় সংসদে তুলে ধরে মেনন বলেন, গত দুই বছরে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। এরা কোভিড পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় খুব বেশি সহায়তা পায়নি। আবার বাজেটে কর্পোরেট করে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা এদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বাস্তবতা হলো এই খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কাজ করেন। অর্থনীতিবিদ এই এইচআর মনছুরও এমনই কথা বলেছেন। আমি সিপিডির কথা বললাম না। তাতে অর্থমন্ত্রীর গাত্রদাহ হবে। তবে সব অর্থনীতিবিদদের মতামতকে উড়িয়ে দেওয়াটা যে গোয়ার্তুমি হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
করের ক্ষেত্রে ৪ কোটি মধ্যবিত্ত ও তদূর্ধ্বদের ওপর আঘাত এসেছে জানিয়ে মেনন বলেন, তাদের করজালে আনুন আপত্তি নাই। কিন্তু সম্পদশালীদের সম্পদ করের ব্যাপারে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে অর্থমন্ত্রী আপনি ৩৮ প্রকার সেবা পেতে কর রিটার্ন দেওয়ার বিধান করছেন মধ্যবিত্তের জন্য। মুসক কর্মকর্তাদের দিচ্ছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার। কি দোষ করেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, গরিব মানুষরা।

করোনা কারণে দেশে ধনী ও গরীবের বৈষম্য আরও বেড়েছে বলে মনে করেন মেনন। তিনি বলেন, এই সময়কালে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর ধনীদের সম্পদ লাফিয়ে বেড়েছে, আর গরীব মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তদের আয় কমেছে। সরকারি কোনো হিসাব নেই অথচ বেসরকারি হিসাবে নতুন তিন কোটি দরিদ্র হয়েছে। সরকার স্বীকার করছে না। তাহলে সরকারিভাবে নতুন জরিপ করুন। দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করুন।

ব্যক্তি করের সীমা ৩ লাখ থেকে ৪ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করেন মেনন। বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ আনুপাতিক হারে কমেছে বলে মনে করেন মেনন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির মহোৎসবটি কোভিডকাল আমাদের দেখিয়েছে। মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাস্তবায়নে তাদের সক্ষমতা নাই। ২০১০-এর জাতীয় শিক্ষানীতি এখন যেন অতীতের ব্যাপার। নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, গণিত পিছিয়েছে। আর দুর্নীতির কথা না বললাম।

তামাক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের অনীহা রয়েছে মন্তব্য করে মেনন বলেন, এ ব্যাপারে বাজেটে কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল সে সম্পর্কেও বড় সংখ্যক সংসদ সদস্য প্রতিবারই আমরা অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেই। কিন্তু লাভ নাই। কেন সেটা উপেক্ষা করা হয়, সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কুড়িগ্রামের ভয়াবহ বন্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বলা হচ্ছে উজানে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি বেড়ে গেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনই কি এর জন্য দায়ী। ভারতের সঙ্গে ৫৪টি নদীর সমস্যা সমাধানে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দীর্ঘদিন না হওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতাশা প্রকাশ করেছেন। বছরের পর বছর তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। আবার তিস্তা নদী খননের যে সমীক্ষা সরকার করেছে তার বাস্তবায়ন হতে পারছে না। কি কারণে? কি সেই ভূ-রাজনৈতিক বাধা? সুরমা নদী শুকনো মৌসুমে হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে। এখন সুরমার পানি সিলেট শহরের বাড়ীতে বাড়ীতে?

অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বাজেটের অন্যতম কৌশল বলেছেন বলে জানান মেনন। তিনি বলেন, কিন্তু কোনো পথ নির্দেশ দেন নাই। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেছিল। আবার তা পুনর্বহাল হোক। টিসিবির গাড়ির পেছনে মধ্যবিত্তদের মুখ লুকিয়ে জিনিস কিনতে হবে না।

দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে গার্মেন্টস শ্রমিক, সরকারি নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিকে ষড়যন্ত্রের অংশ বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন মেনন। তিনি বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করা হোক। সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের দাবিসমূহ বিবেচনায় নেওয়া হোক।

ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম একটি সুখবর উল্লেখ করে তিনি বলেন, খেতমজুরসহ অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জন্য এটা নন-কনট্রিডবিটরি করতে হবে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থার জন্য সরকার দলীয় সংসদ মুজিবুল হকের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন বলে জানান মেনন। 

তিনি বলেন, এই সংসদ সংসদ সদস্যদের পেনশন আইন পাস করেছিল। বিএনপির মহিলা সংসদ সদস্য ফরিদা রহমানের প্রাইভেট মেম্বার বিলে সেটা রদ করা হয়। বোধহয় বিএনপি নেতাদের পেনশন প্রয়োজন হয় না। সংসদ সদস্যের আয় দিয়েই তাদের চার পুরুষ চলতে পারে।

সংস্কৃতি পিছিয়ে গেছে, জায়গা নিচ্ছে কর্পোরেট কালচার, বিপরীত দিকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ধারণা উল্লেখ করে মেনন বলেন, বাজেটে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বরাদ্দ তো হাস্যকর বটেই, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের মনোভাব আরও মারাত্মক। 

এ সময় তিনি যাত্রাপালা, গাজীর গীত, বাউল গান নিষিদ্ধ, মাইজ ভাণ্ডারী গান গাওয়ার অপরাধে শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশে ইসলাম এসেছিল সুফি-সাধকদের মাধ্যমে।

দেশে ওহাবি, সালাফি প্রচারের মতবাদ বাড়ছে উল্লেখ করে মেনন বলেন, জামায়াতিরা নারীকর্মীদের নামিয়ে দিয়েছে তালিমের নামে, পর্দার নামে। নামাজের জায়গা দেওয়ার নামে তাদের রাজনীতির প্রচারে। এই সংসদে আপনারা ছাড়া রাস্তায় বেরোলে বাঙালি ললনা দেখি না। মনে হয় আফগানিস্তানের রাস্তা দিয়ে চলছি।

এইউএ/ওএফ