দেশের পতাকা জড়িয়ে কর্মস্থল থেকে শেষ বিদায় কূটনীতিক মহিউদ্দিনের
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে মাস দুয়েক আগে ফরেন সার্ভিস একাডেমির এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদ। সেদিনের হাফ হাতা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা মানুষটা ৬৩ দিন পর এলেন নিথর দেহে। সাদা কাপনের কাপড় আর লাল-সবুজের গর্বের পতাকা জড়িয়ে।
সোমবার (২০ জুন) উত্তরার বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ। মঙ্গলবার (২১ জুন) উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদে প্রথম জানাজার পর প্রিয় কর্মস্থল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞাপন
জানাজা শেষে মহিউদ্দিন আহমেদের মরদেহ রওনা করেছে গ্রামের বাড়ি ফেনীর উদ্দেশে। আসরের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তাকে।
দ্বিতীয় জানাজা শুরুর আগে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মাঠে বড় ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ছোট ভাই ড. জহির উদ্দিন আহমেদ। কান্নায় গলা ভেঙে আসা জহির বলেন, বাবার মতো ছিলেন তিনি। আমাদের পুরো পরিবারকে দেখেছেন। ভাই বলে বলছি না, মানুষের জন্য কি যে মায়া ছিল ওনার। এলাকার মানুষকেও ভালোবাসতেন খুব।
বিজ্ঞাপন
৮০ বছর বয়সে মারা যাওয়া সাবেক এ কূটনীতিক দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন।
জানাজা শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তরুণ বয়সে বিদেশের মাটিতে নিজের এবং পরিবারের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন তিনি। দেশের পক্ষে কাজ করেছেন বিদেশে বসেই। তার মতো কূটনীতিক দেশকে অনেক দিয়েছেন। সত্য বলতে কখনও দ্বিধাবোধ করতেন না। খুব জ্ঞানী ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব মায়া করতেন।
সাবেক এ কূটনীতিককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, তিনি ছিলেন সত্যভাষী। যার জন্য ওনাকে অনেক সেক্সিফাইস করতে হয়েছে। বিদেশে থেকে প্রথম দিকটাতে যুদ্ধে যোগ দেওয়াদের একজন ছিলেন তিনি। দেশের বাইরে থেকে তার মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন, আমাদের জন্য বড় পাওয়া ছিল।
কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এক সমাবেশে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগের ঘোষণা দেন। ইউরোপে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করা বাংলাদেশি কূটনীতিক। সেই সময়ে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিল এবং ওই ঘটনার ২২ দিন পর ২৩ আগস্ট তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।
প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ফরেন সার্ভিস একাডেমির অধ্যক্ষ ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে গত ১৮ এপ্রিল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ফরেন সার্ভিস ডে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসেন তিনি। বিদেশের মাটিতে বসে কীভাবে দেশের জন্য কাজ করেছিলেন সেই স্মৃতি তুলে আনেন বক্তব্যে। সেদিন সাবেক এ কূটনীতিক বলেছিলেন, আমাদের স্বাধীনতাটা ছিল এক জনযুদ্ধ। ওই সময়ে আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি ছিল দেশ। ইরাক, আর্জেন্টিনা ও ফিলিপিন্সে ওই সময় রাষ্ট্রদূতরা বাঙালি ছিলেন। তারাও পক্ষত্যাগ করেছিলেন। এভাবে বিভিন্ন দেশে যখন কূটনীতিকরা পক্ষত্যাগ করেছিলেন, সারাবিশ্বে কিন্তু একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
মহিউদ্দিন আহমেদর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৯ জুন ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলায় নূরপুর গ্রামে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ভর্তি হন ফেনী কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে অনার্স পাসের পর মহিউদ্দিন আহমদ বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছর মাস্টার্স করে দেশে ফেরেন।
ফেনী কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করলেও বছরখানেক পর করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সে যোগ দেন মহিউদ্দিন আহমেদ। এরপর ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরে শুরু হয় তার কূটনৈতিক জীবন।
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় মহিউদ্দিন আহমেদ তখন লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব। আরও এক বছর লন্ডনে থাকার পর তার পোস্টিং হয় দিল্লি হাইকমিশনে। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর যান জেনেভায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হলে মহিউদ্দিন আহমেদের পেশাজীবনেও নেমে আসে দুর্ভোগ। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিচালক হিসাবে তিন বছর দায়িত্ব পালনের পর মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রথমে ইন্দোনেশিয়ায়, পরে জেদ্দা মিশনে পাঠানো হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসে ঢাকায় ফেরার পর ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন দায়িত্বে তিনি ছিলেন।
এরশাদের সময়ে মহিউদ্দিন আহমেদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে পাঠানো হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ে। সেখানে আড়াই বছর দায়িত্ব পালনের পর পাঠানো হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ে। ছয় মাসের মতো তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। এরশাদের পতন হলে আবার তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরার সুযোগ হয়। পাঠানো হয় নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মিশনের উপস্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে।
চাকরিচ্যুতির পর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। সেই মামলা চলার মধ্যে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন তাকে সচিব হিসাবে পদোন্নতি দিয়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমির অধ্যক্ষ বানানো হয়। এরপর ২০০১ সালের জানুয়ারিতে সচিব হিসেবেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান মহিউদ্দিন আহমেদ।
এনআই/জেডএস