পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় এসব অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গত কয়েকদিনের তুলনায় বর্তমানে সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

সিলেট অঞ্চল পরপর দুই দফায় বন্যার কবলে পড়ার কারণ এবং বাংলাদেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ও করণীয় জানতে ঢাকা পোস্ট কথা বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ. এস. এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে। ড. কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) এবং ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক। তিনি মনে করেন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ কয়েকটি কারণে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আমজাদ হোসেন হৃদয়। 

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব 

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই এবারের এই ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আপার রিজিয়নে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, যা এই বন্যার মূল কারণ। এ বছর ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেখানে তারা বড় দুর্যোগের কথা বলেছে। তারা বলেছে এই অঞ্চলে যদি বন্যা হয় তাহলে এমনই ভয়াবহ হবে, যদি সাইক্লোন হয় তাহলে সেটা সুপার সাইক্লোন হবে। অর্থাৎ তার গতি হবে ২২০ কিলোমিটারের বেশি। এগুলো হচ্ছে আমাদের এই অঞ্চলে। পশ্চিমা বিশ্বের যে দেশে বন্যা কখনো হতো না, এমনকি রাশিয়াও বন্যা আক্রান্ত হয়েছে, জার্মানি বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। আর এগুলো বড় ধরনের বন্যা। এগুলো সবকিছুই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন

এই নগর দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, বন্যার আরেকটি বড় কারণ হলো হাওর এলাকায় যে রাস্তাগুলো করা হয়েছে, সেগুলো করার সময় যে ব্রিজ-কালভার্ট করা হয়েছে, সেখানে বন্যার ভয়াবহতা কেমন হতে পারে সেটা বিবেচনা করা হয়নি। যে কারণে দ্রুত পানি সরতে পারছে না। এই কারণে বন্যার স্থিতিকালটা দীর্ঘ হচ্ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, রাস্তা তৈরি করার সময় সেগুলো স্লোপের আড়াআড়ি করা হয়েছে, সমানভাবে করা হয়নি। সে কারণে রাস্তাগুলো দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে রাস্তা করা হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য, সে রাস্তা হয়ে গেছে এখন মানুষের দুর্ভোগের কারণ।

তিনি বলেন, উন্নয়ন ও দুর্যোগের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। কোনো কোনো উন্নয়ন দুর্যোগ ডেকে নিয়ে আসবে এবং কোনো কোনো উন্নয়ন দুর্যোগ যাতে না হয় সেজন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে হাওর এলাকায় যে রাস্তা-ঘাট করা হয়েছে সেগুলো অপরিকল্পিতভাবে অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি কী প্রভাব পড়তে পারে সে চিন্তা না করে করা হয়েছে। এ কারণে আমাদের দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি

সিলেটে ভয়াবহ বন্যার অন্যতম কারণ মেঘালয়ের অতিবৃষ্টি উল্লেখ করে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি। আসামে বৃষ্টি হলে সেটি দ্রুত বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে নেমে আসে। এবার মেঘালয় আসামে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে সে তথ্য-উপাত্তগুলো আমরা সঙ্গে সঙ্গে পাইনি। দেখা যায় উজানে দ্রুত গতিতে পানি নেমে আসে এবং আমাদের সুরমা, কুশিয়ারা যে শাখা নদীগুলো আছে সেগুলোর অনেকগুলো ভরাট হয়ে গেছে। উজানে বৃষ্টি হলে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি হয়, বালি ক্ষয় হয়, পাথরগুলো ক্ষয় হয়। সেগুলো দ্রুত গতিতে নেমে এসে আমাদের সুরমা, কুশিয়ারাসহ শাখা নদীগুলোর তলদেশে জমা হয়। যার ফলে পানির ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এই কারণে নদী উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।

ভবিষ্যতেও এমন দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে

ভবিষ্যতেও এমন দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে বলে সতর্ক করেছেন অধ্যাপক মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সাময়িক বিষয় নয়, এটা চলমান থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমানোর জন্য ধনী দেশগুলো কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটি তারা পালন করছে না। ধারণা করা হচ্ছে এভাবেই আমাদের চলতে হবে। এমন দুর্যোগ আমরা ভবিষ্যতেও পাব। বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের নদীগুলোকে প্রস্তুত রাখতে হবে, রাস্তা-ঘাট, কালভার্টগুলোকেও প্রস্তুত রাখতে হবে। যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি নেমে আসে এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

পাশাপাশি যারা ডিসিশন মেকার আছেন তারাও তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। আর যেটি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন- আমাদের ভলেন্টিয়ারদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে। এবার সেনাবাহিনীকে ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু লোকাল ভলেন্টিয়ারদের সেভাবে কাজে লাগানো যায়নি। তাই তাদের ট্রেনিং দিয়ে যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

আমাদের কী করণীয়?

অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বন্যার সঙ্গেই বসবাস করে আসছে। আমরা তো বৃষ্টিপাত বন্ধ করতে পারব না, বন্যার সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে। সেজন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী বন্যাপ্রবণ এলাকায় বসতবাড়ির উচ্চতা বাড়ানোর জন্য বলেছেন। পাশাপাশি আরো কিছু উঁচু জায়গা যেন রাখা হয়, যাতে গবাদিপশু ও মানুষের জীবিকা সংরক্ষণ করা যায়।

তিনি বলেন, নদীর গভীরতা আরো বেশি পরিমাণে বাড়ানো উচিত, তবে এটা অনেক ব্যয়বহুল। সরকার এদিকে নজর দিলে হয়তো মূল নদীগুলোর খনন কাজ বাড়িয়ে ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারবে। কিন্তু যেটি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটি হলো উজানে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে যদি আমরা পাই তাহলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওয়ার্নিং দিতে পারব। এজন্য আমাদের দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট রিভার কমিশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য উপাত্ত পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তা পাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ দ্রুত সর্তক সংকেত দিতে পারবে। অন্তত মানুষ তখন জীবন ও জীবিকার জন্য যে কাজগুলো করা দরকার সেটি দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে পারবে।

এইচআর/জেডএস