১১৬ ধর্মীয় বক্তার আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়নি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দেওয়া দুই হাজার ২১৫ পাতার শ্বেতপত্র পরীক্ষা করতে অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মো. মাহবুব হোসেন। 

বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) দুপুরে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয় তিনি এ কথা বলেন। 

দুদক সচিব বলেন, আলেমদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ বিভ্রান্তি দূর করতে সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য প্রকৃত বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, সম্প্রতি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২২১৫ পাতার একটি শ্বেতপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল করে। শ্বেতপত্রটি পরীক্ষা করে সংক্ষিপ্তসার কমিশনে উপস্থাপন করার জন্য দুদক থেকে একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। শ্বেতপত্রটি পরীক্ষা করে কমিশনের কাছে উপস্থাপন করাই এই কমিটির দায়িত্ব। আলেমদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অনুসন্ধানের কোনো দায়িত্ব কমিটিকে দেওয়া হয়নি। এমনকি কমিশন থেকে কোনো অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়নি। 

তিনি আরও বলেন, দুদকের সরাসরি পত্রযোগে ১০৬ হটলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়। অভিযোগ পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে কোনো দুর্নীতির উপাদান বা তথ্য পাওয়া গেলে তা আইনের শিডিউলভুক্ত হলেই অনুসন্ধানের অনুমোদনের জন্য কমিশনে উপস্থাপন করা হয়। এটিই দুদকে অভিযোগ প্রাপ্তি ও নিষ্পত্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, দুদকের গঠিত অভ্যন্তরীণ কমিটি একটি সংক্ষিপ্তসার কমিশনের কাছে উপস্থাপন করবে মাত্র। কমিটিকে কোনো অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বা দুদক থেকে কোনো অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়নি। ধর্মীয় বক্তা বা আলেমদের আর্থিক লেনদেন অনুসন্ধান সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম এ কমিটি শুরু করবে না। এধরনের কোনো দায়িত্ব কমিটিকে দেওয়া হয়নি। কমিটি কেবল শ্বেতপত্রটি পরীক্ষা করে তাদের পর্যবেক্ষণ কমিশনের কাছে উপস্থাপন করবে। পরে কমিশন বিষয়বস্তু বিশদ পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আশা করি এবিষয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ থাকবে না। 

এর আগে গত ২১ জুন দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও উপ-পরিচালক আহসানুল কবীর পলাশ। দুদক এই টিমকেই সংবাদ সম্মেলনে অভ্যন্তরীণ কমিটি বলছে।

এক হাজার মাদরাসার তথ্য-উপাত্তের ওপর তদন্ত করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে গণকমিশন নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে দুর্নীতি দুদকে তালিকা জমা দিয়েছিল। গত ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার কাছে এই শ্বেতপত্র ও ১১৬ সন্দেহভাজন ধর্ম ব্যবসায়ীর তালিকা তুলে দেওয়া হয়। গণকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

তালিকা জমা দেওয়ার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেছিলেন, আমরা ৯ মাস তদন্ত করেছি। বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নিয়েছি। ২২শ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন গত মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়েছি। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমরা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছি। তারা মানিলন্ডারিং করেছে। জামায়াত ও ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। সেই দুর্নীতির তথ্য দিলাম। তাদেরকে বাড়তে দেওয়া যায় না।

দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য তুলে ধরে সাবেক এই বিচারপতি আরও বলেছিলেন, দুদক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন অর্ধশতাধিক ওয়াজ ব্যবসায়ীর দুর্নীতির খোঁজ শুরু করেছেন। আমাদের রিপোর্ট দুদক আইন মতে ব্যবস্থা নেবেন। যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মামনুল হকসহ যারা আছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে।

মানিক বলেন, আমাদের শ্বেতপত্র দুদকের কাজে আসবে। ডিসি, এসপি ও ইউএনওসহ যারা এই গোষ্ঠীদের উস্কানি দেয় তাদের নাম উল্লেখ করেছি। বিশেষ করে নোয়াখালীর এসপির বিরুদ্ধে বলেছি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।

ওইদিন গণকমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, আমরা এক হাজার মাদরাসার ও ওয়াজকারীদের ওপর তদন্ত করেছি, শ্বেতপত্রে বিস্তারিত আছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও হেফাজতের কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে। তাদের অর্থনৈতিক জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।

এর কয়েকদিন পর গত ২৩ মে দুপুরে দুদক চেয়ারম্যানের কা‌ছে স্মারকলিপি দেন ইসলামি কালচারাল ফোরাম বাংলাদেশের নেতারা। যেখানে ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়-ব্যয়ের হিসাব ও তহবিলের উৎস, কমিটির নেতাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং গণকমিশনের শ্বেতপত্রসহ অতীতে তাদের প্রকাশিত শ্বেতপত্রের আর্থিক জোগান ও আয়-ব্যয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করার অনুরোধ করেন তারা।

স্মারকলিপি দেওয়া শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে ইসলামী কালচারাল ফোরামের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরা কওমি মাদরাসা থেকে শিক্ষা নেয়। সরকারি অনুদান না নিয়ে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষিত জাতি গঠনে আমরা নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছি। অথচ আমাদের উৎসাহ না দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তারা এসব হীন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে সংঘাত ঘটাতে এসব কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে। যারা আমাদের রাজপথে নামতে বাধ্য করছে, তাদের অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য আমরা দুদককে আহ্বান জানিয়েছি। পাশাপাশি তাদের আয়-ব্যয় ও অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে আমরা দুদককে অনুরোধ করেছি। 

আরএম/জেডএস