নানা বিতর্ক ও সমালোচনা উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে উদ্বোধন করা হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর। সেতু উদ্বোধন ঘিরে আফগানিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার সবকটি দেশ বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে পাওয়া এসব অভিনন্দন বার্তা প্রতীকী নয়, বরং এ অঞ্চলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতার জানান দিচ্ছে বলে ভাষ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।

মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশ আঞ্চলিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা কোনো প্রতীকী অভিনন্দন নয়। এটা হচ্ছে এ অঞ্চলে বাংলাদেশের যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে তারই প্রমাণ। অর্থাৎ পুরো অঞ্চলে গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে অন্য উচ্চতায় রয়েছে বাংলাদেশ। আর এটাই হচ্ছে ঢাকার পররাষ্ট্র নীতির সফলতা।

মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতু ইস্যুতে আমাদের এই অঞ্চলের সবগুলো দেশ অভিনন্দন জানিয়েছে। আফগানিস্তান ছাড়া এ অঞ্চলের ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ সবাই অভিনন্দন জানিয়েছে। এটা বিরাট অর্জন। এটা এমনি এমনি সম্ভব হয়নি বা এসব অভিনন্দন কোনো প্রতীকী নয়। আঞ্চলিকভাবে আমরা স্বীকৃতিটা পেলাম। এটা সম্ভব হয়েছে এ অঞ্চলে আমাদের আউটলুক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে। এটা আমাদের পররাষ্ট্র নীতির সফলতারও একটা জায়গা।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও এশিয়ার অনেক দেশ পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে। অভিনন্দন জানিয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশ।

বিশ্ব ব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর ভর করে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির কথা বলে এ প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সংস্থাগুলো। পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে সেতুর কাজ শুরু হয়।

সাত বছরের নির্মাণ কাজ শেষে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু গত ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ২৬ জুন রোববার সকালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় পদ্মার বিশাল জলরাশির উপর নির্মিত সেতুটি। যেটি দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত করে। 

এদিকে, মঙ্গলবার (২৮ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে পদ্মা সেতু উদ্বোধন পরবর্তী আলোচনায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের মূলকেন্দ্রে পরিণত করতে ভূমিকা রাখবে। সেদিক থেকে পদ্মা সেতুর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বের প্রতিফলন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন। এই সেতু আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় ও সুসংহত করবে।

গত বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে বাংলাদেশ। ঢাকার ওই আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার শীর্ষ নেতারা। পাঁচ দেশের ওই নেতাদের ঢাকায় আনার দায়িত্ব পালন করতে হয় সচিব মাশফিকে। সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমরা মুজিববর্ষে যেটা দেখলাম, পাঁচটা দেশের শীর্ষ নেতারা ঢাকায় এসেছেন। এরপর আবার এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেলাম। এটা খুব ছোট বিষয় নয় কিন্তু। তার মানে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান বা আউটরিচ অন্য উচ্চতায় রয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি সফল। এটা এখন আমরা মোটামুটি বলতে পারি এ অঞ্চলে আমরা ভালো অবস্থানে এসেছি। আমরা আমাদের বিষয়টা যেভাবে বুঝি সেটা কিন্তু অন্যরা বুঝবে না।

বাংলাদেশের কূটনীতির পুরো সাফল্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে চান সচিব মাশফি। মাশফি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আঞ্চলিক আউটলুক আছে। তিনি সবসময় বলেছেন, এই অঞ্চল নিয়েই কাজ করতে হবে। এ অঞ্চলে কানেকটিভিটি বাড়াতে হবে, ট্রেড বাড়াতে হবে; পিপল টু পিপল কনট্রাক্ট বাড়াতে হবে। মোদ্দা কথায় ওনার (প্রধানমন্ত্রীর) বার্তা হচ্ছে, এ অঞ্চলে সহযোগিতা বাড়াতে হবে; উন্নতি করতে হবে।

পুরো অঞ্চলে বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে অবদান রাখছে উল্লেখ করে মাশফি বিনতে শামস বলেন, আমরা এখানে ভালো রোল প্লে করছি। যে কারণে পুরো অঞ্চলে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা অন্য উচ্চতায় আছে। আমরা শ্রীলঙ্কার কঠিন পরিস্থিতিতে পাশে দাঁড়িয়েছি। তাদের যতটা পারা যায় সহযোগিতা করছি। আফগানিস্তানের জনগণের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। মালদ্বীপকে টিকা দেওয়ার জন্য মেডিকেল টিম পাঠিয়েছি। নেপাল বা ভুটান যে যা চেয়েছে আমরা কিন্তু সেটা দিয়েছি। ভারতকেও আমরা সহযোগিতা করেছি।

প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানোর এ মানসিকতা কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নয়, বরং সম্পর্কের দিক বিবেচনায় চিন্তা করে জানিয়ে মাশফি বলেন, আমরা সুবিধা পাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি না। আমাদের সহযোগিতার মানসিকতা আছে। সম্পকর্কে আগে গুরত্ব দেই আমরা। বাংলাদেশ সহযোগিতায় বিশ্বাসী।

প্রতিবেশীর অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ‘শঙ্কা’

ভূ-রাজনীতিতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের কদর বাড়ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তালেবান সমর্থিত আফগানিস্তান স্বীকৃতিসহ নানা জটিলতায় দিন পার করছে। অন্যদিকে আর্থিক অব্যবস্থাপনায় খারাপ সময় পার করছে শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তানেও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। 

এ অঞ্চলে এমন পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে কি না-জানতে চাইলে সচিব মাশফি বলেন, বর্তমানে এই অঞ্চলে অনেকের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে তিনটি দেশ আনস্টেবল অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেখা যাবে বাংলাদেশের দিকে অনেক ইনভেস্টমেন্ট এসেও পিছিয়ে যেতে পারে। তারা চিন্তা করবে বাংলাদেশ ভালো আছে, কিন্তু তার পাশের দেশের অবস্থা ভালো না; হয়ত বাংলাদেশও ওইদিকে যাবে। যে কারণে আমরা এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চাই। সেজন্য আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখার চেষ্টা করছি।

এনআই/জেডএস