ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানার বিরুদ্ধে গ্রাহকের সাড়ে ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ই-অরেঞ্জ নামীয় এমএলএম কোম্পানি খুলে সাধারণ গ্রাহকদের ওই টাকা নিজ ও তার সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ৬টি ব্যাংকের ৩১ হিসাবে জমা করে, পরে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। 

সোমবার (৪ জুলাই) অর্থ আত্মসাৎ ও মানিলংন্ডারিং আইনে সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুদক। শিগগিরই অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন মামলাটি দায়ের করবেন। সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আরও পড়ুন>> ৭৭ কোটি টাকা ফেরত চেয়ে ই-অরেঞ্জের ৫০০ গ্রাহকের রিট

অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সোহেল রানার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে ই-কমার্স গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে পাচার ও দেশত্যাগের অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেন। ওই প্রতিবেদন অনুসারে দেখা গেছে, শেখ সোহেল রানা নিজের পদ পদবি আড়াল করে দুর্নীতি সম্পৃক্ত অপরাধে ই-অরেঞ্জ নামীয় এমএলএম কোম্পানি খোলেন। এরপর প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তার নিজ নামে ও তার সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ৬টি ব্যাংকের ৩১ হিসাবে মোট ২৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫০ টাকা জমা করেন। যার মধ্যে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৯১৩ টাকা উত্তোলন করেছেন। যে কারণে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারা, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলা অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।

এর আগে গত ১৬ মার্চ ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানার অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে তদারককারী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

যদিও সোহেল রানার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় সোহেল রানার চারটি ফ্ল্যাট, ৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাণিজ্যিক ভবন, বেশ কিছু জমির প্লট রয়েছে। এছাড়াও এলিট ক্লাবের সদস্যপদ, চারটি ভিন্ন দেশে সম্পত্তি ও শত-শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

চারটি ফ্ল্যাটের মধ্যে দুটি রাজধানীর নিকেতনে। সোহেল রানার মালিকানাধীন টিঅ্যান্ডজি নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি শাখা গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে, আরেকটি রয়েছে উত্তরার গরিব-ই-নেওয়াজ অ্যাভিনিউতে।

রিয়েল এস্টেটের প্রতি বিশেষ ঝোঁক থেকে পূর্বাচলের সেক্টর ৩-এ একটি প্লট, কুড়িল বিশ্বরোড লাগোয়া একটি আবাসিক এলাকার ই ও আই ব্লকে দুটি প্লট এবং খাগড়াছড়িতে রিসোর্টের জন্য জমি কিনেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্দায় ওই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে ধরা পড়েন।

মোট ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট প্রতারণার শিকার গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম মামলা ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে দায়ের করেন। ওই সময় তার সঙ্গে প্রতারণার শিকার আরও ৩৭ জন উপস্থিত ছিলেন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ওই মামলা দায়ের করা হয়। মামলার আসামিরা হলেন- ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, আমানউল্ল্যাহ, বিথী আক্তার, কাউসার আহমেদ ও পুলিশের বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা।

ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের স্বত্বাধিকারী সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান বর্তমানে কারাগারে আছেন। তারা বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক সোহেলের বোন ও ভগ্নিপতি।

শুরু থেকেই ই-অরেঞ্জের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন সোহেল রানা। তবে ই-অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠান খুলতে নেওয়া টিআইএন সনদে পরিচালক হিসেবে সোহেল রানার নাম দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিভিন্ন সময়ে আড়াই কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ভারতে আটক হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল রানা অপরাধমূলক একাধিক কাজে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন বিএসএফের কর্মকর্তারা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলেছে, সম্ভবত গা ঢাকা দেওয়ার লক্ষ্যে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন সোহেল রানা। যদিও এখন পর্যন্ত দেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।

আরএম/জেডএস