গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের সভাপতি-সম্পাদক গ্রেপ্তার
গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা হলেন- সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ।
রমনা থানাধীন সেগুনবাগিচা আকরাম টাওয়ারের পাশে থেকে মঙ্গলবার (৫ জুলাই) ভোর সাড়ে ৪টায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
বিজ্ঞাপন
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিএমপি'র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ও ডিবি-উত্তরের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
উল্লেখ্য, গত ২৩ মে ১১০টি মামলা প্রত্যাহারের শর্তে গ্রামীণ টেলিকমের চাকরিচ্যুত ১৭৬ জন শ্রমিকের পাওনা বাবদ ৪৩৭ কোটি টাকায় সমঝোতা করে গ্রামীণ টেলিকম। তারও আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমের অবসায়ন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়।
গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে এ আবেদন করা হয়।
ডিবি গুলশান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ৪ জুলাই গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী এবং টেলিকম ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান (৩৮) মিরপুর মডেল থানায় এ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলায় বাদী উল্লেখ করেন, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারীদের স্থায়ী না করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ক্রমাগত নবায়ন করে।
শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী বাৎসরিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ ৮০-১০:১০ অনুপাতর ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বরাবর প্রদান করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির ‘কর্মচারীরা স্থায়ী নয়’ এবং ‘কোম্পানি অলাভজনক’ ইত্যাদি কথা বলে শ্রমিকদের আইনানুগ লভ্যাংশ দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কারণে গত ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে একসঙ্গে ৯৯ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করে। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ ও লভ্যাংশ পাওনা, বেআইনিভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পর কোম্পানিতে পুনর্বহাল, কোর্টের আদেশ অনুযায়ী পুনর্বহালের পরও দায়িত্ব না দিলে-কনটেমপ্ট অব কোর্ট, কোম্পানির অবসায়ন দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে শ্রমিকরা এবং শ্রমিক ইউনিয়ন গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শ্রম আদালত এবং হাইকোর্টে প্রায় ১৯০টি মামলা ও রিট পিটিশন দায়ের করেন।
তড়িঘড়ি করে অনেকটা গোপনে এসব মামলা উত্তোলন, শ্রমিকদের অর্থ প্রদান এবং প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, গত ১০ মে ঢাকা ব্যাংক গুলশান শাখায় একটি সেটেলমেন্ট একাউন্ট খোলা হয়। ২০১০-২০২২ পর্যন্ত প্রতি বছর কোম্পানির মোট লভ্যাংশের ৫ শতাংশ টাকা হারে সেই সেটেলমেন্ট একাউন্টে প্রায় ৪৩৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়।
একাউন্টটি থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের এম.ডিকে বাধ্যতামূলক সিগনেটরি এবং ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অন্য দুই সিগনেটরি হিসেবে রাখা হয়। শ্রমিকদের সব পাওনাদি ওই একাউন্ট থেকেই পরিচালিত হওয়ার কথা।
চুক্তি অনুযায়ী সেটেলমেন্ট একাউন্ট থেকে শ্রমিকদের পাওনা এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ব্যতীত অন্য কোনো অর্থ ছাড় করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিধি বহির্ভূতভাবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং ওই দুই সিবিএ কর্মচারীসহ ইউনিয়নের কিছু নেতার যোগসাজশে ওই একাউন্ট থেকে গত ১৭ মে এবং ২৫ মে ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকা গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের ডাচ বাংলা ব্যাংকের একাউন্টে নিয়ে আসা হয়।
গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের ওই একাউন্টের মোট তিনজন সিগনেটরি ছিলেন। তারা হলেন- সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং মামলার বাদী অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান।
অন্যান্য শ্রমিকদের মতো টাকা পাওয়ার পরও যোগসাজশে সিবিএ সভাপতি কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান এবং সহ-সভাপতি মাইনুল হাসান ইউনিয়নের একাউন্ট থেকে তাদের ডাচ বাংলা ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের একাউন্টে তিন কোটি করে মোট নয় কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করে।
ইউনিয়নের নিয়োজিত আইনজীবী অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জিতভাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ফি ও পারিতোষিক হাতিয়ে নেয় বলে তারা জানায়।
ডিবি গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রেজাউল হক রেজা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিবি-গুলশান বিভাগ মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা আরও জানায়, লভ্যাংশ পাওনা পরিশোধ, অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার প্রলোভনের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকম অফিস ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষ মেসেজ ছড়িয়ে দেয় যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলংকার মতো হবে। ক্ষমতার পট-পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর ইউনুস। তখন শ্রমিকদের এসব মামলা কোনো কাজে আসবে না, কোনো ক্ষতিপূরণও পাবে না। বিপরীতে তাদের চাকরি হারানো, জেল খাটাসহ অন্যান্য নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে।
মূলত এই ভয়ে এবং কিছুই না পাওয়ার অনিশ্চয়তার বিপরীতে আইনজীবীর পরামর্শে তারা অতি দ্রুততার সঙ্গে অর্থ তুলে নেয়। টেলিকম ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও আইনজীবী একাধিকবার এই সমঝোতার বিষয়টি গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে বলেন।
আদালত গ্রেপ্তারদের সাত দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবে পুলিশ।
জেইউ/এমএইচএস