বঙ্গবন্ধু আমাদের জায়গা না দিলে হয়তো আমার ছেলেদের রিকশা চালাতে হতো, না হয় ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে হতো। উনি জমি দেওয়ায় আমার জীবনটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার তিন ছেলেই আজ গ্রাজুয়েট। কথাগুলো ষাটোর্ধ্ব মো. শরিফ হোসেনের। যিনি ভূমিহীন হিসেবে দেশের প্রথম পুনর্বাসিত ২১০ জনের একজন। লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলাধীন চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামে তার বসবাস।

মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) দুপুরে গুচ্ছগ্রামে শরিফের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তার ভাষ্য অনুযায়ী, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তৎকালীন নোয়াখালীর রামগতি চরলক্ষ্মী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তার পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি মেঘনার পেটে পুরোপুরি চলে যায় ৭০ সালেই। সব হারিয়ে নিঃস্ব শরিফদের বাবা তার পরিবারের ১০ সদস্য নিয়ে রামগতির ওয়াপদার বেড়ির পাশে আশ্রয় নেয়। সেখানে এত বড় পরিবার নিয়ে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় থাকতে হয় তাদের।

সময়কাল ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সদ্য স্বাধীন দেশে ঢাকার বাইরে প্রথম সফরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলাধীন চরপোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শনে আসেন। বঙ্গবন্ধুর এ সফর জীবন বদলে দেয় শরিফ এবং তার পরিবারের। কেননা, ওই সফরে বঙ্গবন্ধু সেখানকার ভূমিহীন-গৃহহীন ও অসহায় মানুষদের পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। তারই নির্দেশনায় সেখানকার নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। প্রতিটি পরিবারকে ২ দশমিক ৫০ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়। যেটি ছিল দেশের ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষকে দেওয়া প্রথম পুনর্বাসন।

ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ৫০ বছর আগে ফিরে যান শরিফ। তিনি বলেন, আমার বয়স তখন ১৩। বঙ্গবন্ধু তখনকার চরপোড়াগাছা গ্রাম দেখতে আসেন। তখন উনি আমাদের মতো ২০০ গৃহহীনকে জায়গা দেন। পরে আরও ১০ জনকে দেওয়া হয়। আমার বাবাও জমি পেয়েছেন।

ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর উপহারের জমি পেয়ে জীবন বদলে যায় উল্লেখ করে শরিফ বলেন, নদী ভাঙার পর আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। দিশেহারা আমার পরিবারের প্রায় তিন বছর অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জমি দেওয়ার পর আমাদের জীবন বদলে যায়। জমি পাওয়ায় জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে আছি। ছেলেদের পড়াশোনা করাতে পেরেছি। আমার তিন ছেলেই গ্রাজুয়েট। ছোট ছেলে অনার্স শেষ করেছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু জমি না দিয়ে গেলে আমার ছেলেদের হয়তো রিকশা চালাতে হতো, না হয় ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে হতো। উনি এটা না করলে আজ আমরা অবহেলিতভাবে থাকতাম। সর্বস্বান্ত হয়ে যেতাম।

রামগতি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খাঁন বলেন, ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলাধীন চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষে প্রতিটি পরিবারকে ২ দশমিক ৫০ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়।

সময়কাল ২০২২। ৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধু যেখান থেকে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন শুরু করেন, সেই স্মৃতিবিজড়িত চরপোড়াগাছা গ্রামের (বর্তমান-ইউনিয়ন) চরকলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫ দশমিক ১৫ একর অবৈধ দখল উদ্ধারকৃত খাস জমিতে নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে, ভিক্ষুক, বিধবা ও অসহায় ১৪২টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আর এটি হতে যাচ্ছে তারই কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।

বঙ্গবন্ধু থেকে সরাসরি জমি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ একরাম উদ্দিন বলেন, রামগতির চরলক্ষ্মী গ্রামে আমার বাবার ভিটা ছিল। নদী আমাদের সব নিয়ে গেছে। আমরা অনেক সম্পদ থাকলেও সব নদীতে চলে যাওয়ায় আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে আমি জমি পাই। এটা চর ছিল। কুঁড়েঘর দিয়ে শুরু করি। এখন আমার পাকা ঘর। আমরা খুব ভালো আছি।

বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে সরাসরি জমি পাওয়াদের আরেকজন মাঈনউদ্দিন দুলাল বলেন, মেঘনা আমাদের সব নিয়ে গেছে। জমি হারিয়ে নানা বাড়িতে থাকতাম। বঙ্গবন্ধু জমি দেওয়ায় এখানে আসি। বঙ্গবন্ধু সহযোগিতা না করলে এখনো হয়তো নানার বাড়িতে বা অন্যের বাড়িতে থাকতে হতো।

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুনর্বাসিত ২১০ পরিবার দিয়ে শুরু হলেও বর্তমান পরিবার সংখ্যা পাঁচ শতাধিকের বেশি। আর সব মিলিয়ে মোট লোকসংখ্যা ২ হাজারের বেশি। মোট জ‌মি ৫৯০ একর। পুকুর ২২ টি। ১০টি প‌রিবার এক‌টি পুকুর ব‌্যবহার ক‌রে।

৩নং চর পোড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে বসবাসকারীদের কেউ ভূমিহীন বলতে পারে না। তাদেরও পরিচয় আছে, জমি আছে। তারা এখানে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন।

মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীন সব অসহায় মানুষকে নতুন ঘর উপহার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তার আওতায় দেশের পাঁচ জেলার ২৬ হাজার ২২৯টি নতুন পরিবার ঘর পেতে যাচ্ছে। আগামী বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) ঘর উপহার দেওয়ার এ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

এনআই/ওএফ