দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সরকারি কলেজের আলোচিত অধ্যক্ষ মনজুর আলমের বিরুদ্ধে প্রায় তিন কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির অভিযোগ এনে অধ্যক্ষের অপসারণ ও শিক্ষকদের বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে অধ্যক্ষ মনজুর আলমকে অবরুদ্ধ করেছিলেন শিক্ষকরা। শেষ পর্যন্ত পুলিশকে গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হয়।

এ ঘটনার পর দুদকের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে এবং অনুসন্ধানে অধ্যক্ষ ও তার অফিস সহকারী নির্মল চন্দ্র দেবশর্মার বিরুদ্ধে কলেজের বিভিন্ন খাতের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। যে কারণে গত ২১ জুলাই তাদের আসামি করে জালিয়াতি ও আত্মসাতের মামলা করে দুদক। দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।

ওই মামলায় দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতার অব্যবহার করে কলেজের ২ কোটি ৮৫ লাখ ৯৪ হাজার ৭১২ টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪২০/১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, আসামিরা বিভিন্ন কৌশলে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল ক্যাশ বইতে আয় কম দেখানো। ক্যাশ বইয়ে আয় কম দেখিয়ে ১ কোটি ৯৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৭ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। আরেকটি কৌশল হচ্ছে ভুয়া ভাউচারে আত্মসাত। যার মধ্যে রয়েছে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩টি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ৮ হাজার ২৯৩ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮টি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৭২ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪টি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ৬৪ হাজার টাকা, অনুরূপভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬টি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ৫২ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩টি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ২০ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৯টি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৬২ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে সবমিলিয়ে ২৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা লুটপাট হয়েছে।

আরও পড়ুন: কারাগারে তাৎক্ষণিক অভিযানের ক্ষমতা হারাল দুদক

ক্যাশ বইতে প্রদর্শন না করে ৬টি জাল রশিদের মাধ্যমে ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ১২০ টাকা, রশিদের মূল কপি ও কার্বন কপিতে টাকার পরিমাণ পরিবর্তন করে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৯০০ টাকা আত্মসাতও করেন তারা। এছাড়াও ভিন্ন দুটি খাতে জাল ভাউচারের যথাক্রমে ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৭ টাকা ও ১৭ লাখ টাকা আত্মসাত করে অধ্যক্ষ সিন্ডিকেট।

সবমিলিয়ে আত্মসাতের মোট পরিমাণ ২ কোটি ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার ৬০২ টাকা। যেখান থেকে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ব্যয় ১০ লাখ ৪ হাজার ৮৯০ টাকা বাদ দিলে ২ কোটি ৮৫ লাখ ৯৪ হাজার ১২ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে দুদকের অনুসন্ধানে। ২০১১ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন কৌশলে ওই টাকা আত্মসাত করেন আসামিরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে অধ্যক্ষের অপসারণ ও বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে শিক্ষকরা সেতাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মনজুর আলমকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। একদিকে অর্থ আত্মসাত, অন্যদিকে অনার্স বিভাগের ৩৬ শিক্ষকসহ ৭০ জন শিক্ষকের বেতন বকেয়া রাখেন অধ্যক্ষ।

ওই সময় শিক্ষকরা জানান, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে সাত সদস্য বিশিষ্ট অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৯১ লাখ ৭০ হাজার ১৭৮ টাকা আত্মসাতের প্রাথমিক সত্যতা পায়। সেসব তথ্যসহ কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছিল।

যদিও ওই সময় অধ্যক্ষ মনজুর আলম গণমাধ্যমে অভিযোগ অস্বীকার করেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। আমি যদি কলেজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে থাকি তাহলে আমি পদত্যাগ করব।

ওই সময় পাওয়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক এ এইচ আশিকুর রহমান ও সহকারী পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমানসহ একটি তদন্ত দল সেতাবগঞ্জ কলেজ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। পরে কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির সাত জন সদস্যের বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়।

আরএম/এসএসএইচ