বর্তমান সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলো ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। গত ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মাসেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের লক্ষ্য, এ বছরের মধ্যেই মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্পগুলো চালু করা।

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন চলছে স্টেশন তৈরি করা এবং রেললাইন বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশাল এই প্রকল্প একটা চেহারা পাওয়ার আগেই যত্রতত্র পোস্টার লাগানোসহ নানাভাবে এর সৌন্দর্যহানির অভিযোগ উঠেছে। 

রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে মেট্রোরেলের পিলার ও ভায়াডাক্টসহ বিভিন্ন অংশ। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউ পিছিয়ে নেই এই বেআইনি কাণ্ডে। 

আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি

সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁও থেকে মিরপুর-১২ নম্বর পর্যন্ত ঘুরে মেট্রোরেলের পিলারে পিলারে হরেক রকম পোস্টার দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ছিঁড়ে যাওয়া পোস্টারের জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। মিরপুর-১২ নম্বর থেকে মিরপুর-১০ নম্বর পর্যন্ত মেট্রোরেলের প্রতিটি পিলারে তান্ত্রিক বিজয় বৌদ্ধ কবিরাজ-এর পোস্টার লাগানো হয়েছে। রেটিনা কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন আর ওরস মোবারকের বিভিন্ন পোস্টারও লাগানো হয়েছে বহু জায়গায়। 

কয়েকটি পিলারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিশাল ছবি দিয়ে পোস্টার লাগিয়েছেন ঢাকা উত্তরের যুবদল নেতা শফিকুল ইসলাম মিল্টন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানিয়ে পোস্টার লাগিয়েছেন বিএনপি নেতা আমিনুল হক। এছাড়া জাতীয় পার্টির নেতা আলহাজ আমানত হোসেন আমানতের বড় বড় পোস্টারও লাগানো আছে মেট্রোরেলের পিলারে।

একইভাবে পোস্টার লাগিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের ছবি সম্বলিত পোস্টার লাগিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল জালিল, ঢাকা-১৬ আসনের এমপি আলহাজ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা, শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মো. তারিক হাসান কাজল।

পিলারের গায়ে যত্রতত্র পোস্টার, ছেঁড়া-কাটা পোস্টার ও ফেস্টুন দেখতে বেশ খারাপ লাগে সাধারণ পথচারীদের। মোফাজ্জেল হোসেন নামে এক পথচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেলের পিলারগুলো যখন নির্মাণ করা হয়েছিল, তখন থেকে এগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। দেখতে ভালোই লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে এসব পোস্টারের অত্যাচারে পিলারগুলোর সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর একটা স্থাপনা, পোস্টারের জন্য দেখতে খারাপ লাগে। সরকারের উচিত যারা পোস্টার লাগায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

আরও পড়ুন : ১১,৫১৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়াতে একনেকে উঠছে মেট্রোরেল প্রকল্প

নকিব নামের কাজীপাড়ার এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের উন্নয়নের সৌন্দর্য তাদের নেতাকর্মীরাই নষ্ট করছে। তাদের দেখাদেখি জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের পোস্টার লাগানো হচ্ছে। পোস্টার লাগানোর এই বেআইনি কার্যক্রম চলছে পাল্লা দিয়ে।
 
মেট্রোরেল প্রকল্পে কাজ করছেন কাউসার নামে এক ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়তই পোস্টার লাগানোর মাধ্যমে মেট্রোরেলের সৌন্দর্য নষ্ট করছেন। আমরা নিষেধ করলেও তারা পাত্তা দেন না। আমাদের কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহেই মেট্রোরেলের পিলারে লাগানো পোস্টারগুলো তুলে ফেলে। কিন্তু আঠা দিয়ে লাগানোয় সম্পূর্ণভাবে পোস্টার তোলা সম্ভব হয় না। ফলে আবশিষ্ট অংশ ছোট ছোট দাগের মতো থেকে যায়। কিছুদিন পরে সেখানে আবার পোস্টার লাগায় কেউ না কেউ। এভাবে আরও নোংরা হয়ে ওঠে পিলারগুলো।    

এ বিষয়ে মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা পোস্টার দেখলেই ছিঁড়ে দিচ্ছি কিন্তু আবার এসে পোস্টার লাগায়। আমরা এগুলো বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন জনকে ফোন করে সতর্ক করেছি। মেট্রোরেলের সৌন্দর্য নষ্ট না করতে বিভিন্ন জায়গায় সর্তকতামূলক নির্দেশনাও লাগিয়েছি।’ 

আরও পড়ুন : মেট্রোরেলের ব্লকের ইট পড়ে পথচারী নিহত

‘আমাদের নির্দেশনায় বলা আছে, মেট্রোরেলের পিলারের সৌন্দর্য নষ্ট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আমাদের কাউন্সেলিং কার্যক্রমের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এখন আমরা অ্যাকশনে যাব। প্রথমে আমরা থানায় জিডি করব, এতে যদি কাজ না হয় তাহলে যিনি প্রচার করেন ওনার নামে মামলা করব।’

তিনি বলেন, ‘এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মেট্রোরেল আইনও লাগে না। আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অনেক ক্ষমতা আছে, তারাই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আমরা ইতোমধ্যে তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পেয়েছি। আরও তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরকারের কাছে চেয়েছি। মেট্রোরেলের ২০ কিলোমিটার ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেটকে ভাগ করে দেব। তারাই মেট্রোরেলের সার্বিক বিষয়গুলো দেখবেন এবং প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।’

মিরপুর-১২ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কবে নাগাদ নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন রাস্তায় যেসব কাজ হচ্ছে, সেগুলো আমাদের কাজ নয়। স্টেশন এলাকা ছাড়া মতিঝিল পর্যন্ত আমাদের কোনো কাজ নেই। মিডিয়ামগুলো অনেক সুন্দরভাবে করে দিচ্ছি। আমার যেহেতু প্রকৃতির দিকে আকর্ষণ আছে, সেহেতু মিডিয়ামগুলো দোআঁশ মাটিতে ভরাট করেছি। দোআঁশ মাটিতে গাছ লাগালে ৫০ বছরেও মরবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এই কাজগুলো করছি।’  

আরও পড়ুন : মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ শেষ


 
এম এ এন ছিদ্দিক আরও বলেন, ‘আমরা এখনও মেট্রোরেল এরিয়াতে গাছ লাগাইনি। এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সাথে বসেছি। আমরা তাদের বলেছি, মেট্রোরেলের স্টেশন এলাকাগুলো ছাড়া বাকি এলাকাগুলো আপনারা নিয়ে নিন। কারণ সৌন্দর্য বর্ধন করা সিটি করপোরেশনের কাজ। আমাদের কাজ ছিল ভালো মাটি দিয়ে মিডিয়াম করে দেওয়া, সেটা আমরা করেছি। আমরা সিটি করপোরেশনকে সৌন্দর্য বর্ধন করতে পরামর্শ দিয়েছি। তবে আমরা সিটি করপোরেশনের সাথে আবার বসব। তারা যদি সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ না করে তাহলে আমাদের কাছে যেন হস্তান্তর করে। ডিপো এলাকার ভেতরে যে খালি জায়গাগুলো আছে সেখানে আমরা বৃক্ষ রোপনের উদ্যোগ নিয়েছি। সেখানকার পরিবেশ সুন্দর ও নান্দনিক করার কাজ চলছে।’

এসআর/জেএস