সোমবার (১ আগস্ট) দুপুর ১২টা। রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজার ১ নম্বর লেভেল ক্রসিং। ট্রেন আসার তথ্য পেয়ে হুইসেল বাজিয়ে ব্যারিকেডগুলো নামিয়ে দেন ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যান। তবে থেমে থাকে না মানুষের পারাপার। যে যার মতো করে গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যারিকেড ডিঙিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন।

ঘড়ির কাঁটায় সময় ১২টা ৩ মিনিট। কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী ট্রেন এফডিসি লেভেল ক্রসিংয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এ সময় স্কুলড্রেস পরা দুই সন্তান নিয়ে দৌড়ে ব্যারিকেড পার হতে দেখা গেল এক ব্যক্তিকে। ট্রেন চলে যাওয়ার পর অনেকটা দৌড়ে গিয়ে কথা হয় আব্দুল আলিম নামে ওই ব্যক্তির সঙ্গে। 

জানতে চাওয়া হয়- ঝুঁকি জেনেও সন্তানদের নিয়ে এভাবে পার হলেন কেন? জবাবে আলিম বলেন, বাসা থেকে স্ত্রী জানাল, সন্তানদের স্কুল ছুটির পর যেন দ্রুত যাই। অফিস থেকে আধা ঘণ্টার জন্য বের হয়েছি। সময় কম থাকায় এই তাড়াহুড়ো। তবে আমার অপেক্ষা করা উচিত ছিল।

দেশের বিভিন্ন স্থানে গত সাত মাসে রেল দুর্ঘটনায় ১৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ, শুক্রবার (২৯ জুলাই) চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলস্টেশন এলাকায় পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাস চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের সামনে এসে পড়ে। ট্রেনের ধাক্কায় সেটি চলে যায় প্রায় এক কিলোমিটার। এতে মাইক্রোবাসে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন : রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত?

ওই রাতে টাঙ্গাইলের গোপালপুরের হেমনগর ইউনিয়নের ভোলারপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ে চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় ২ অটোযাত্রীর মৃত্যু হয়। তার পাঁচদিন আগে গত ২৪ জুলাই গাজীপুরের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেল সড়কের মাইজপাড়া ক্রসিংয়ে শ্রমিকবাহী বাসে ট্রেনের ধাক্কায় চার শ্রমিক নিহত হন।

সেভ দ্য রোডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সাত মাসে মোট ১ হাজার ৫২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত হয়েছে ১৭৮ জন এবং আহত ১ হাজার ১৭০ জন। রেলের ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এর মধ্যে ৩৩টি ক্রসিং কে বা কারা ব্যবহার করছে, তা কেউ জানে না। এ ছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম মাসে ২৬টি রেল দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ৪১টি দুর্ঘটনায় ২৭ জন, মার্চে ২২২টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন, এপ্রিলে ১১২টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন, মে মাসে ২১২টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন, জুনে ১৯৭টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন এবং জুলাই মাসে ১৪২টি দুর্ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার বড় কারণ পুরনো সিগন্যাল ব্যবস্থা। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় সিগন্যাল ব্যবস্থা কাজ করে না। এতে সময়মতো সিগন্যাল পান না গেটম্যানরা। 

সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ছয়দিনে দেশে ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছে রেল দুর্ঘটনায়। যার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে অরক্ষিত, অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত লেভেল ক্রসিংগুলোতে নিরাপত্তার অভাব, আর মানুষের অসচেতনতা।

সোমবার ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক আড়াইঘণ্টা ধরে সরেজমিনে কারওয়ান বাজার সংলগ্ন পূর্ব তেজতুরী বাজার ১ নম্বর রেল গেট এবং এফডিসি সংলগ্ন ক্রসিং প্রত্যক্ষ করেন। দেখা গেছে, ট্রেন আসার খবর পেয়ে গেটম্যান রাস্তার দুই ধারের ক্রসিং ব্যারিয়ারগুলো নামিয়ে দেন। কিন্তু পথচারীরা অবাধে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন। ট্রেন খুব কাছে চলে আসা অবধি তাদের রাস্তা পারাপার চলছিল।

পথচারীরাই শুধু নয়, মোটরসাইকেল চালকরা দুর্ঘটনার কথা মাথায় না রেখে অবাধে ক্রসিং বারের নিচ দিয়ে যাতায়াত করছে। কেউ কেউ ক্রসিং বারের সামনে গিয়ে সাইকেল শুইয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ ক্রসিং বার মাথার ওপর তুলে বাইক বের করে নিয়ে গেছেন।

আশপাশের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব লেভেল ক্রসিং দিয়ে অনেক গাড়ি ইউটার্ন নেয়। এতে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় বড় ধরনের যানজটের সৃষ্টি হয়। এফডিসি অংশের ক্রসিংয়ে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তেজতুরী বাজার অংশে নেই। যে কারণে দেখা যায় অনেক সময় সিগনাল মানতে চান না গাড়ি চালকরা।

আরও পড়ুন : রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?

ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে কারওয়ান বাজার লেভেল ক্রসিংয়ে ব্যারিয়ারের নিচ দিয়ে রাস্তা পার হওয়া এক পথচারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়- ঝুঁকি নিয়ে পার হওয়ার কারণ কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘জ্ঞান দেবেন না। আমার তাড়া আছে। ট্রেন আসার আগে তো পার হতে পেরেছি।’

ওই রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যান মো. হারুন জানান, এখানে চারটা গেট আছে। গেটম্যান আছে ১২ জন। শিফটিংয়ে আমরা দায়িত্ব পালন করি আট ঘণ্টা করে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয় আমাদের। দেখা যায়, ট্রেন আসার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যারিয়ার ফেলতে চাই। কিন্তু অনেকে জোর করে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। তাদের তো না যেতে দিয়ে উপায় থাকে না। অনেকে রং সাইড দিয়ে ঢুকে ঝামেলা বাড়ায়। অনেকে গালি দেয়, হুমকি দেয়। অনেক বড় বড় অফিসারও এসব কাজ করে।

গেটম্যানদের দেওয়া তথ্য বলছে, ঢাকার এ রেল লাইন দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ৯০ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। আর আট ঘণ্টায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জোড়া ট্রেনের জন্য ব্যারিয়ার ফেলতে হয়। তবে ছুটির দিনগুলোতে এ সংখ্যা কিছুটা কমে যায়।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে এক গেটম্যান বলেন, ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার বড় কারণ পুরনো সিগন্যাল ব্যবস্থা। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় সিগন্যাল ব্যবস্থা কাজ করে না। এতে সময়মতো সিগন্যাল পান না গেটম্যানরা। অনেক ট্রেন চালক ক্রসিংয়ের খুব কাছাকাছি এসে হর্ন বাজান। প্রতিটি ক্রসিংয়ের আগে সতর্কীকরণ ডব্লিউ বোর্ড ব্যবহার করা হতো আগে। যেটা এখন অনেক জায়গায় আর নেই। আবার অনেক রেলক্রসিংয়ে সিগন্যাল বাতি জ্বলে না। পাওয়া যায় না সতর্কীকরণ সাইরেন।

এনআই/এসএম/জেএস