জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে গণপরিবহনসহ সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া। বর্ধিত ভাড়া দিতে যাত্রীরা বাধ্য হলেও তাদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। এদিকে পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, ভাড়া বেশি হওয়ায় যাত্রী প্রায় অর্ধেক কমেছে। সবমিলিয়ে তেলের তেলেসমাতির কারণে বিপাকে পড়েছেন যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার (৮ আগস্ট) রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা উঠেছে। এমন অবস্থায় তেলের দাম কমিয়ে ভাড়া নিয়ন্ত্রণের দাবি করেছেন সাধারণ মানুষ।

পরিবারের কাছে ময়মনসিংহ যাবেন মো. এনায়েত হোসেন। তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। ভাড়া বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে ২৬০ টাকায় যেতাম, এখন এক লাফে ৩২০ টাকা হয়ে গেছে। আমরা যারা নিয়মিত যাতায়াত করি, তাদের জন্য বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে গেছে।

এনায়েত হোসেন বলেন, আমরা চাই যেকোনো উপায়ে ভাড়া কমানো হোক। যে হারে ভাড়া বেড়েছে, সেভাবে আমাদের পোষাবে না। তেলের দাম বাড়িয়ে দেবেন, যানবাহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেবেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেবেন, তাহলে আমরা চলব কী করে?

‘এমনিতেই চলতে-ফিরতে কষ্ট, এরমধ্যে আবার ভাড়া বেড়েছে’

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. আকাশ মিয়া বলেন, ভাড়া বাড়ায় আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এমনিতেই আমাদের চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়। দেশের যা অবস্থা, এভাবে তো চলতে পারে না। বর্তমানে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। আমাদের যে আয়, সে আয় দিয়ে চলতে-ফিরতে তো আমাদের কষ্ট হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের প্রতি দাবি, অতি দ্রুতই বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করা হোক। পাশাপাশি যতদিন এই বর্ধিত ভাড়া চলবে, ততদিন যেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

কিশোরগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশে মহাখালী বাস কাউন্টারে আসেন মো. কামরুল ইসলাম। পেশায় তিনি দারোয়ান। ভাড়া বেশি হওয়ায় সকাল থেকে বেশ কয়েকটি কাউন্টার ঘুরেছেন। অবশেষে বাধ্য হয়েই টিকিট কিনেছেন তিনি।

ভাড়ার প্রসঙ্গে কামরুল ইসলাম বলেন, নতুন করে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা আমাদের জন্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। আমরা তো গরিব মানুষ। সবকিছুর দাম যদি বাড়তে থাকে আমরা যাব কই? কিশোরগঞ্জে এমনিতেই অনেক বেশি ভাড়া। এখন আরও বাড়ানো হয়েছে। আগে ছিল ২৭০ টাকা, এখন করা হয়েছে ৩৩০ টাকা।

‘যাত্রী কম, বর্ধিত ভাড়ায় যাত্রীরা যেতে চায় না’

নতুন ভাড়ার প্রসঙ্গে ঢাকা-মধুপুর-টাঙ্গাইল রুটের একটি বাসের কাউন্টার মাস্টারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এই রুটে আগে ভাড়া ছিল ৩২৬ টাকা। ফোনে নতুন ভাড়ার যে চার্ট আমরা পেয়েছি, সে অনুযায়ী এখন ৩৯৮ টাকা। আমরা যাত্রীদের থেকে ৪০০ টাকা চাচ্ছি। কিন্তু যাত্রী তো অনেক কমে গেছে। বাড়তি ভাড়ায় যাত্রীরাও যেতে চাচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, একেক জন এসে ভাড়া বলে দুইশো, আড়াইশো বা তিনশো টাকা। আমরা আর কী করব, সেভাবেই নিয়ে যেতে হচ্ছে। নতুন ভাড়ায় আসলে আমরাও ঝামেলায় পড়ে গেলাম। ভাড়া বেশি নেওয়া তো পরের কথা, ঠিকঠাক যাত্রীই তো পাচ্ছি না।

ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে চলাচলকারী লাবিবা ক্লাসিক পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার মো. সোহাগ মিয়া (বাবু) ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএর চার্ট অনুযায়ী আগে রুটের ভাড়া ছিল ২৬৬ টাকা। সেখানে আমরা ভাড়া নিতাম ২৪০ টাকা। এখন নতুন ভাড়া অনুযায়ী ৩২০ টাকা আসে। সেখানেও আমরা ৩০০ টাকা নিচ্ছি। কিন্তু যাত্রী আগের চেয়ে অনেক কম পাচ্ছি।

তিনি বলেন, এখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দূরত্ব ১১২ কিলোমিটার। সে তুলনায় নতুন ভাড়াটা আসলেই একটু বেশি। যে কারণে যাত্রীও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

ভাড়া কমানোর সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একমাত্র জ্বালানি তেলের দাম কমলেই কেবল ভাড়া কমবে। এছাড়া সম্ভব নয়।

বেশির মধ্যেই ‘আরও বেশি’ ভাড়া কিশোরগঞ্জের বাসে

ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের যাত্রীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ‘বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়’। সরকার নতুন করে যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তা কার্যকর হওয়া এই রুটের যাত্রীদের জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’।

জানা গেছে, গাইটাল থেকে কাপাসিয়া হয়ে মহাখালী টার্মিনালের দূরত্ব ১১০ থেকে ১১২ কিলোমিটার। নরসিংদী হয়ে যেসব গাড়ি চলাচল, সেগুলোর দূরত্ব হয় ১২০ থেকে ১২৫ কিলোমিটার। কিন্তু পরিবহন কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী রাস্তা আঁকাবাঁকার কারণে সেই দূরত্ব গিয়ে দাঁড়ায় ১৩০ কিলোমিটারের বেশি। সে হিসাবেই ভাড়া আদায় করা হয়।

এই বিষয়ে কাউন্টার মাস্টার শামীম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের ভাড়া ছিল ২৭০ টাকা। বর্তমান বিআরটিএর চার্ট অনুযায়ী ভাড়া আসে ৩৬৭ টাকা। কিন্তু আমাদের মালিক সমিতি ভাড়া কমিয়ে ৩৩০ টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া বেশি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী তো আরও বেশি ভাড়া আসে। কিন্তু আমরা তো ৩৩০ টাকা নিচ্ছি। এর বেশি আমরা আর কী করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, গাড়ি যদি সোজা যেতো, তাহলে ওই দূরত্ব কম হতো। কিন্তু আমাদের গাড়ি অনেকটা ঘুরে যায়। যে কারণে দূরত্ব এসে দাঁড়ায় ১৩০ কিলোমিটারে। আর এই হিসাব তো আমাদের নয়। বিআরটিএর চার্ট দেখুন, তারাও তো এটাই বলছে।

যাত্রী হারাচ্ছে এনা পরিবহন, তেলের দাম কমানোর দাবি

মহাখালী থেকে ময়মনসিংহগামী অন্যান্য বাসের তুলনায় উন্নত সেবা দিয়ে থাকে এনা পরিবহন। তাই যাত্রীও বেশি পেয়ে থাকে পরিবহনটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মচারী বলেন, অন্যদের মতো আমাদেরও যাত্রী কমে গেছে। কারণ হলো, যেখানেই যান আমাদের ভাড়া একটাই।

তিনি বলেন, আপনি ময়মনসিংহ গেলেও ভাড়া ৩২০ টাকা, গাজীপুর গেলেও একই ভাড়া। নতুন করে ভাড়া বাড়ায় গাজীপুর, মাস্টারবাড়ি, ভালুকার নিয়মিত কিছু যাত্রী আমাদের হারাতে হচ্ছে। কারণ, আগের ভাড়া যাত্রীদের জন্য কিছুটা সহনশীল থাকলেও বর্তমান ভাড়াটা তাদের জন্য অনেকটাই বেশি। এর কারণে যাত্রীরা অন্য পরিবহনে কম ভাড়ায় চলে যাচ্ছে।

এসব বিষয়ে কথা বলেন এনা পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার। তিনি বলেন, আমাদের আগের ভাড়া ছিল ২৬০ টাকা। নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২০ টাকা। আগে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ছিল ১ টাকা ৮০ পয়সা, এখন হলো ২ টাকা ২০ পয়সা। সে হিসেবে আমাদের ভাড়া আসে ৩২৬ টাকা, কিন্তু আমরা ৬ টাকা কম নিচ্ছি।

যাত্রীরা কেমন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাড়া বাড়লে শুরুতে তাদের একটু প্রতিক্রিয়া থাকেই। যাত্রীরা বলছে ভাড়া বাড়ায় তাদের জন্য চাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। যেহেতু তেলের দাম বেড়েছে, সে কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা ভাড়া নিচ্ছি।

সাময়িক সমস্যা মেনে নিতেই হবে : বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট

বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এম সাজ্জাদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হলো জনগণ যেন হয়রানির শিকার না হয়। সরকার নির্ধারিত যেই ভাড়া, এর বেশি যেন তারা না নিতে পারে। আমরা গতকাল থেকেই বাস টার্মিনালগুলোতে অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু সেগুলোতে বেশি ভাড়া নেওয়ার কোনো প্রমাণ পাইনি। আপনারাও দেখছেন, তারা আসলেই নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় কম নিচ্ছে।

তিনি বলেন, যেহেতু তেলের দাম বেড়েছে, সেহেতু সাময়িক একটু সমস্যা আমাদের মেনে নিতেই হবে।

টিআই/এমএইচএস