চট্টগ্রামে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। নিকট ভবিষ্যতে দাম কমার কোনো আভাস নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

মিল মালিক ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ আড়তদারদের। তারা আমদানির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।

বুধবার চট্টগ্রামের চাক্তাই ও পাহাড়তলী চালের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্বর্ণা সিদ্ধ চালের প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৫০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। নাজিরশাইল নামে পরিচিত চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়।

পাহাড়তলী বাজারে জিরাশাল চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়। মোটা আতপ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকা । বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চিনিগুড়া চালের দাম। চিনিগুড়া চাল বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি ৬ হাজার টাকায়।

কাজীর দেউড়ি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চিনিগুড়া খুচরায় বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। নাজিরশাইল ৩ হাজার ৮০০, জিরাশাল ৩ হাজার ৬০০ টাকায়।  স্বর্ণা (সিদ্ধ) কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়।

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে  চালের বাজার খুবই অস্থির।  তেলের দাম বাড়ার কারণে মিল মালিক ও বিভিন্ন সিন্ডিকেট মিলে চালের দাম বাড়িয়েছে। মিল মালিক ও করপোরেট গ্রুপ— যারা চাল মজুত করে রাখছে, তারা চালের দাম প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে।  এলসি করা চাল বাজারে এখনও প্রবেশ করেনি।

এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, চট্টগ্রামে চাল মূলত আসে দিনাজপুর, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গ থেকে। চালের বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি এক বস্তায়) ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে।  আর চিনিগুড়া চাল বস্তাপ্রতি ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।  

তিনি বলেন, মোটা সিদ্ধ চাল আগে বিক্রি হতো ১ হাজার ৮০০ টাকায়। এখন সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। আর জিরাশাল চাল আগে বিক্রি হতো ৩২শ টাকায়। এখন সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। নাজিরশাইল আগে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকায়। পাইজাম আগে বিক্রি হতো ২ হাজার ৪০০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়।  বলা যায় বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে চালের দাম।

বাজারে চালের সরবরাহ আছে দাবি করে তিনি বলেন, চালের দাম ওরাই বাড়িয়ে ফেলছে। মিল, করপোরেট ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মিলে দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। 

চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী শান্ত দাশগুপ্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন,  জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে চালের পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।  আগে ১৩ টন ওজনের ট্রাকভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা। তা বেড়ে গিয়ে এখন হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। প্রতি বস্তায় চালের খরচ বেড়ে গেছে, যে কারণে চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। 

তিনি বলেন, ভারতীয় নাজিরশাইল চাল প্রতি বস্তা (২৫ কেজিতে এক বস্তা) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৫০ টাকায়।  আগে এ চাল বিক্রি হতো ১ হাজার ৬৮০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। জিরাশাল ৫০ কেজি বস্তার এক বস্তা  ভালো চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫০ টাকা করে। এ চাল বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। আর মোটা আতপ বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। আর স্বর্ণা সিদ্ধ চালের দাম বেশি বেড়ে গেছে।  আগে ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৫০ টাকায়।

সামনে চালের দাম কমার সম্ভাবনা আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামনে চালের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম। ভাদ্র মাসে নতুন চাল বাজারে আসার কথা। বর্তমানে ১৫ শতাংশ ডিউটি দিয়ে চাল আমদানি করতে হয়। এটি যদি ফ্রি করে দিত বা কমিয়ে দিত, তাহলে কিছুটা কমত।

চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চালের দাম বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ চাল আসে উত্তরবঙ্গ, আশুগঞ্জ,  হবিগঞ্জ ও সিলেট  অঞ্চল থেকে। এসব অঞ্চল থেকে চাল নিয়ে আসা প্রতিটি ট্রাকে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে চালের ওপর। তবে পরিবহন খরচ যত পড়ে, তার থেকে অনেক বেড়ে গেছে চালের দাম।  এমনিতে চালের ক্রাইসিস আছে। বস্তাপ্রতি চালের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

তিনি বলেন, স্বর্ণা সিদ্ধ চালের দামটা বেশি বেড়েছে।  আগে এই চাল বিক্রি হতো ২ হাজার ৩৫০ টাকায়। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। এরপর ২৮ চাল বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৫০ টাকা। নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা করে। চিনিগুড়া চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

সামনে চালের বাজার কেমন হতে পারে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডলারের অবস্থা তেমন ভালো না , ডিউটিও বাড়তি। আমদানি করা চাল যদি বেশি পরিমাণে বাজারে না আসে, তাহলে চালের আরও ক্রাইসিস হতে পারে। চালের দামও আরও বাড়তে পারে।

চট্টগ্রাম কাজির দেউড়ি বাজারের মেসার্স ফয়েজ স্টোরে জসিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তেলের দাম বাড়ার পর বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আমরা খুচরায় চাল বিক্রি করি। আড়তদারদের থেকে বেশি দামে চাল কিনে আনার কারণে আমাদের বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।

একই বাজারের খান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতভেদে চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চিনিগুড়া চাল সপ্তাহখানেক আগে কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হলেও আজ বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা কেজি দরে। স্বর্ণা সিদ্ধ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা দরে। আমাদের বেশি দামে চাল কিনতে হয়েছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন করে তারা একটি অজুহাত পেয়েছে দাম বাড়ানোর। তেলের দাম কেমন বেড়েছে, আর চালের দাম কেমন বাড়িয়েছে সরকারের তা দেখা উচিত।  ব্যবসায়ীরা তো অযৌক্তিক হারে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। জ্বালানি তেলের ইস্যুটাকে সামনে এনে তারা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের উচিত দ্রুত বাজার তদারকি শুরু করা। একটু সুযোগ পেলেই চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ চালের দাম বাড়িয়েছেন, তেলের দাম কিন্তু তেমন বাড়েনি।

তিনি বলেন, এখন দরকার বিষয়গুলো সরকারের খতিয়ে দেখা। শুধুমাত্র বাজার মনিটরিং ভোক্তা অধিদপ্তরই দেখে। কিন্তু এ জায়গাতে সরকারের অন্যান্য যেসব বিভাগ আছে, যেমন— জেলা প্রশাসক,  খাদ্য অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সবাই মিলে মনিটরিং করা উচিত। সবাই মিলে দেখা উচিত কেন চালের দাম এত বাড়ছে।

কেএম/আরএইচ