২১ বছর আগে স্ত্রীকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আলম গ্রেপ্তার এড়াতে ঠিকানা ও পেশা বদল করে আত্মগোপনে চলে যান। নতুন নামে তৈরি করেন জাতীয় পরিচয়পত্র। ঠিকানা দেন কাজী আলাউদ্দিন লেন, বংশাল।

শুধু তাই নয়, মায়ের নাম পরিবর্তন করে আলেয়া বেগমের স্থলে জাহানুর বেগম ও বাবার নাম পরিবর্তন করে রইস উদ্দিনের স্থলে মো. ইয়াসিন ব্যবহার করেন।

দীর্ঘ গোয়েন্দা অনুসন্ধানের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকায় আগুনে পুড়িয়ে আম্বিয়া হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আলমকে ২১ বছর পর গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব । শনিবার (১৩ আগস্ট) রাতে রাজধানীর বংশাল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৪ এর একটি দল।

রোববার (১৪ আগস্ট) র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।

মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেপ্তার মো. আলম ও নিহত আম্বিয়া মানিকগঞ্জের সিংগাইরের একই গ্রামের বাসিন্দা। তার সঙ্গে ২০০১ সালের জুনে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন আটিপাড়া গ্রামের মকবুল হোসেনের মেয়ে আম্বিয়া বেগমের (১৮) পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় ভিকটিমের বাবা সামর্থ্য অনুযায়ী আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার প্রদান করেন। কিন্তু আলম বিয়ের পর থেকেই আরও যৌতুকের দাবিতে প্রায়ই তার স্ত্রী ভিকটিম আম্বিয়াকে মারধর করতেন।

আরও পড়ুন : এক মাসের আগে কমছে না জ্বালানি তেলের দাম, ইঙ্গিত প্রতিমন্ত্রীর

একপর্যায়ে আলমসহ আসামির বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়-স্বজন ভিকটিমের পরিবারের কাছে আরও ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করে। ভিকটিমের বাবা দরিদ্র হওয়ায় যৌতুকের টাকা দিতে ব্যর্থ হন। দাবি করা যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় আম্বিয়ার ওপর বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে বাবা মকবুল ধার দেনা করে জামাতা আলমকে ১০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু যৌতুকের বাকি টাকা পেতে নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেয় আলম। মারধর করে ভুক্তভোগী আম্বিয়াকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় আসামিরা। টাকা ছাড়া ফিরে আসলে হত্যার হুমকিও দেয় আলম।

২০০১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে আম্বিয়ার বাবার বাড়িতে এসে আম্বিয়াকে ঘরের বাইরে ডেকে চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি মারতে থাকে আলম। এরপর পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সঙ্গে আনা পেট্রোল ঢেলে আম্বিয়ার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

গুরুতর অগ্নিদগ্ধ আম্বিয়াকে প্রথমে সিংগাইরের সেবা ক্লিনিকে এরপর দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে এক দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। 

পরবর্তীতে রমনা থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে আম্বিয়ার মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত শেষে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে।

২০০১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নিহতের বাবা মকবুল হোসেন বাদী হয়ে সিংগাইর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। আসামি করা হয় জামাতা আলম, আলমের বাবা রইস উদ্দিন, মা আলেয়া বেগম, আলমের বোন জামাই রবিউল, আলমের চাচাতো নানা আফতাব। মামলার পর থেকে আলম আত্মগোপন করেন। যে কারণে থানা পুলিশ আসামি আলমকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয়।

মামলার তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি আলমের বিরুদ্ধে আদালতে দ্রুত সময়ের মধ্যে চার্জশিট জমা দেন।

পরবর্তীতে চার্জশিটের ভিত্তিতে মানিকগঞ্জ জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল আম্বিয়াকে হত্যায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে আলমকে মৃত্যুদণ্ড দেন।  

পরবর্তীতে ডেথ রেফারেন্সের জন্য মামলা উচ্চ আদালতে গেলে রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। ২০০৬ সালের ৬ জুন আলমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রকাশ পায়।

আরও পড়ুন : নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন প্রধানমন্ত্রী : ডিএমপি কমিশনার 

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক ডিআইজি মোজাম্মেল বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ১৯৮২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন আটিপাড়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন আলম। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় আলম স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। আম্বিয়াকে বিয়ের ৩ মাসের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ৫ বছর পর পুনরায় ঢাকার বংশাল এলাকায় নিজের নাম ঠিকানা গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।  আসামি আলম তার দ্বিতীয়কে নিয়ে ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। ২০০১ সালের পর থেকে আসামি আর কোনোদিন মানিকগঞ্জে যায়নি। 

বাবা-মাসহ নিজের নাম পরিবর্তন, বাসা-পরিবর্তনে আত্মগোপন 

পরিচিত লোকজন থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য ঘটনার পর ২০০১ সালে ঢাকায় চলে আসেন। ২১ বছর ধরে আলম এনআইডিতে নিজের নাম ঠিক রেখে বাবা-মায়ের নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে বারবার পেশা পরিবর্তন করেছেন।

প্রথম দিকে তিনি পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতেন। পরে বাসা পরিবর্তনের শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিছুদিন যাবত তিনি বংশালে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।

নতুন ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি

আলম নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য কাজী আলাউদ্দিন লেন, বংশাল, ঢাকার ঠিকানায় এনআইডি তৈরি করেন। নিজের মায়ের নাম পরিবর্তন করে আলেয়া বেগমের স্থলে জাহানুর বেগম ও বাবার নাম পরিবর্তন করে রইস উদ্দিনের স্থলে মো. ইয়াসিন নাম ব্যবহার করে বসবাস করে আসছিলেন।

জেইউ/এসকেডি