দেশে অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটতে পারে— এমন আশঙ্কা আঁচ করতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বড়জোর সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে জাতির পিতাকে সসম্মানে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তাতে বরং খুশিই হতেন বঙ্গবন্ধু। তবে বাঙালি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করতে পারে না এ দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল বাংলার রাখাল রাজার বুকে। এমন বর্ণনা পাওয়া যায় এম আর আখতার মুকুল রচিত ‘মহাপুরুষ’ বইয়ে। সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

‘১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবেমাত্র দেশে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকার চিলি থেকে বিশ্বের পত্র পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা এবং বেতার ও টিভির মাধ্যমে পাক্কা খবর এসে পৌঁছাল সান্টিয়াগোতে ব্যাপক রক্তপাতের মাঝ দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী সমাজতন্ত্র মতাদর্শের কমরেড আলেন্দের সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। চিলির বিমান বাহিনী ও ট্যাংক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে প্রেসিডেন্টের প্যালেস এখন ধূলিসাৎ। বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট আলেন্দে এবং তার বহু সহকর্মী নিহত।’

‘পাশ্চাত্য পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে চিলিতে শুরু হয়েছে গণহত্যা। রাজধানী সান্টিয়াগোর ফুটবল খেলার স্টেডিয়ামে এখন প্রতিদিন শত শত বামপন্থী সমর্থকদের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। হাজার হাজার লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, অভিনেতা, গায়ক এবং চিত্রশিল্পী হয় পলাতক, আর না হয় স্বেচ্ছায় নির্বাসিতের জীবনকে বরণ করে নিয়েছে। চিলির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মহাদুর্যোগ। চিলির ক্ষমতা এখন সামরিক জান্তার কব্জায়। স্বঘোষিত নতুন ফৌজি প্রেসিডেন্ট হলেন জেনারেল পিননা চেট।’

‘সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর দৈনিক জনপদ সম্পাদক গাফফার চৌধুরী আর আমি যেয়ে হাজির হলাম গণভবনে। তখন ঘড়িতে বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে আলাপের এটাই হচ্ছে প্রকৃষ্ট সময়। দলীয় নেতৃবৃন্দ, সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মচারী এবং তোষামোদকারীদের সবাই এ সময় মোটামুটিভাবে অনুপস্থিত। প্রধানমন্ত্রীর পার্সোন্যাল স্টাফের জনা কয়েক পাশের কামরায় দিবা-নিদ্রায় মগ্ন। কেবলমাত্র সাদা পোশাকে গোয়েন্দা বিভাগের দুজন। ঘরের বাইরে দোতলায় বারান্দায় পায়চারি করছে। আর অদূরে নিচের তলায় ও গেটে ডিউটিরত আর্য গার্ড। গণভবনের দোতলায় প্রধানমন্ত্রীর বেডরুমের ভেজানো দরজা ঠেলে দিতেই খুলে গেল। সব কটা জানালায় টেনে দেয়া ভারী পর্দা। ঘরের ভেতর আধো অন্ধকার। বিছানায় বঙ্গবন্ধু একটা বালিশ মাথা গুজে উপুড় হয়ে।’

‘আমরা দুজনা নিঃশব্দে ঘরের মাঝখানে এসে হতভম্বের মতো দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে গুরুগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন, কে? কেডা? পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, লাইট জ্বালাইয়া দে, আর চেয়ার টাইনা বয়। তোগো লগে কথা আছে। এর মধ্যেই শেখ মুজিব নিজেকে সামলিয়ে বিছানায় উঠে বসেছেন। সাইড টেবিল থেকে পাইপটা নিয়ে ধরিয়ে বললেন, তোরা বোধ হয় শুনছোস যে, চিলিতে হেরা আলেন্দের শ্যাষ করছে? এবার কার পালা?’

‘এরপর কিছুক্ষণ আলাপ হলো আলজিয়ার্স জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে  ফিদেল কাস্ত্রোর দেওয়া হুঁশিয়ারির কথা। হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু বললেন, আর পারিনা। সব বেটাই চোর। যাকেই দায়িত্ব দিতাছি সেই-ই চুরি করছে। এবার ভাবতাছি, ফ্রান্সের দ্য গল-এর মতো রিটায়ার করুম। পাবলিক মিটিংয়ে বলুম এবার আপনারা নতুন নেতা দেখেন। আমি গামছা কাঁধে মনপুরায় (ভোলার অন্তর্গত) চললাম।’

‘কথা কটা বলেই বঙ্গবন্ধু নিভে যাওয়া পাইপটা আবার জ্বালিয়ে গাফফার চৌধুরীর দিকে তাকালেন উত্তরের আশায়। গাফফার সাহেব হাত কচলিয়ে জবাব দিলেন। মুজিব ভাই, যদি বেআদপী না নেন তো বলি। দেশ শাসনের ব্যাপারটা বাঘের পিঠে চড়ার মতো। একবার যখন বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন, তখন নামা এতো সহজ নয়। হয় আপনি চাবকিয়ে বাঘকে বশে আনবেন, না হয় বাঘই আপনাকে খেয়ে ফেলবে। এখানে আপসের কোনো প্রশ্নই উঠে না।’

‘বঙ্গবন্ধু মুহূর্ত কয়েক ঠোঁট কামড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলেন তো, আমার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কী কী দোষ আছে? গাফফার চৌধুরী তড়িৎ উত্তর দিলেন, অভয় দিলে বলতে পারি। আপনি শেরে বাংলা ফজলুল হকের মতো মাদার্স হার্ট, মানে কিনা মায়ের ক্ষমাসুন্দর হৃদয় নিয়ে দেশ শাসন করছেন। তাই সমস্যা অনেক বেশি মনে হচ্ছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাবার সময় আপনার হৃদয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো নির্দয় হলে, এতদিনে অনেক এগোতে পারতেন।’

‘একজন পদস্থ সরকারী কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও আমি হঠাৎ করে বলে উঠলাম, স্যার, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি তো ছিলেন পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি জেলে। আপনি জানেন না, কাদের ক্ষমা করেছেন? অথচ মুজিবনগর সরকারের প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল যে, কেউ নিজের হাতে বিচার তুলে নেবেন না। কেবলমাত্র সুষ্ঠু বিচারের পর দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হবে। তা হলে আমাদের ওয়াদার ইজ্জত রইলো কই?’

‘বঙ্গবন্ধু কী যেন চিন্তা করে হঠাৎ বিকটভাবে চিৎকার করে উঠলেন, তোমরাই তো আমার এই সর্বনাশ করেছো।? কেননা আমাকে জাতির পিতা বানাইলা? পিতা তো ক্ষমা করবেই। জবাবটা দিলেন গাফফার চৌধুরী। আপনি হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা। তাই আমরা সবাই মিলেই আপনাকে জাতির পিতা বানিয়েছি। কিন্তু সেদিন পর্যন্ত যারা এ ব্যাপারে কথায় কথায় বাড়াবাড়ি করছিল, তাদের অধিকাংশই এখন জাসদ করছে। বাকিরা যুবলীগে রয়েছে।’

‘এবার নিভে যাওয়া পাইপটা টেবিলের ওপর রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিচু গলায় বললেন, শোনেন সাহেবেরা, চিলিতে তো আলেন্দেরে শ্যাষ করছে। কিন্তু আমারে এমতে কাইত করতে পারব না। যখন কারবার করব, তখন তিন বাহিনীর তিন চিফ আইস্যা আমারে স্যালুট দিয়া কইবো, স্যার অনেক দিন তো গভর্নমেন্ট চালাইলেন। আপনি এখন টায়ার্ড হইয়া পড়ছেন। এই কাগজের মধ্যে দস্তখত কইরা এখন রেস্ট নেন। আপনি জাতির পিতা ঠিকই থাকবেন। এই না কইয়া, আমার কাছ থাইক্যা দস্তখত আদায় করব। আমিও দস্তখত দিয়া যামুগা মনপুরায়। এরপর বুঝতেই তো পারতাছেন। কম্যুনিস্টরা যাইব আন্ডারগ্রাউন্ডে। তখন আপনাগো মতো ন্যাশনালিস্টগো এরা তক্তা বানাইব।’

‘ঘরের মধ্যে তখন এক অসহনীয় পরিবেশ। অজানা আশঙ্কায় মনটা কেঁপে উঠল। বঙ্গবন্ধু আবারও কথা বললেন, আমি যখন থাকুম না, তখন আমার দাম বুঝবেন। বটগাছ পইড়া গেলে হাওয়ার দাপট টের পাইবেন। কথা কটা বলেই তিনি আবার পাইপ ধরালেন। আমরা দুজন হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম।’

তথ্যসূত্র : মহাপুরুষ, লেখক : এম আর আখতার মুকুল

এইউএ