চকবাজারের কামালবাগে প্লাস্টিক গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা সবাই আগুন লাগা ওই ভবনের নিচ তলার বরিশাল হোটেলের স্টাফ। তাদের সবার পরিচয় জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) মরদেহ ময়নাতদন্তের পর ছয় জনের নাম জানান সিআইডির কর্মকর্তারা। নিহতরা হলেন- ওহাব আলী ওসমান (২৫), বেল্লাল সরদার (৩৫), স্বপন সরকার (১৮), মোতালেব (১৬) ও শরীফ (১৬) ও রুবেল (২৮)।

এদিকে এতো বড় অগ্নিকাণ্ড ও ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় রুবেলের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী চকবাজার থানায় একটি মামলা করেছেন। এছাড়া ঘটনার পর পরই ভবন ও প্লাস্টিক গোডাউনের মালিক লাপাত্তা রয়েছেন। শুধুমাত্র ভবনের নিচে থাকা বরিশাল হোটেলের মালিক ফখরুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছে চকবাজার থানা পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা প্লাস্টিক নামে চারতলা ওই ভবনের মালিক চকবাজারের আলম সাহেব। আলম সাহেবের মৃত্যু পর তার ছেলে মো. রানা এসব কিছুর দেখাশোনা করেন।

আরও জানা যায়, ভবনটির দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং টিন শেড দিয়ে তৈরি করা চতুর্থ তলায় পলিথিন ও প্লাস্টিকের খেলনার কারখানা এবং গোডাউন রয়েছে। এই গোডাউন ও কারখানার মালিক মো. নজরুল। দীর্ঘ দিন ধরে তিনটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে তিনি কারখানা ও গোডাউনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।

অন্যদিকে নিহত ৬ জন বরিশাল হোটেলে কাজ করতেন। যেটি ভবনের নিচ তলায় অবস্থিত। এই রেস্টুরেন্টের মালিক ফখরুদ্দিন। তিনি মূলত বরিশালের বাসিন্দা। মাত্র ৬ মাস আগে ভবনের নিচ তলা ভাড়া নিয়ে হোটেলটি দিয়েছিলেন।

লাপাত্তা ২ মালিক

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই এই তিন মালিক লাপাত্তা ছিলেন। পরে অভিযান চালিয়ে হোটেলের মালিক ফখরুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বাকিদের সঙ্গে হাজার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারছেন না।

তবে ভবন ও গোডাউন মালিককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খুঁজছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

হোটেল থেকে আগুনের সূত্রপাত

প্রত্যক্ষদর্শী ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, ঢাকা প্লাস্টিক ভবনের আগুনের সূত্রপাত ঘটে বরিশাল হোটেলে থেকে। হোটেলের চুল্লির সঙ্গে সংযুক্ত থাকা গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দিল মোহাম্মদ নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগুন লাগার ঠিক আগ মুহূর্তে আমি হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হোটেলের চুল্লিটি পাড় হওয়া মাত্রই বিকট শব্দ। এর পরেই দেখি পুরা হোটেলে চুল্লি থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আগুন পৌঁছে যায়।

এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরিশাল হোটেল। হোটেলটির চুল্লি ও গ্যাস সংযোগের লাইন একদম বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। দুর্ঘটনার পর চুল্লির বার্নারটি খুলে রাস্তায় পড়ে ছিল।

বদ্ধ প্রকোষ্ঠে ঝরল ৬ তাজা প্রাণ

ঢাকা প্লাস্টিক নামে ভবনটি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চারতলা ভবনটির তৃতীয় তলা পর্যন্ত পাকা। চতুর্থ তলা তৈরি করা হয়েছে টিন শেড দিয়ে। নিচ তলার এক পাশে বরিশাল হোটেল ও অন্য পাশে কয়েকটি প্লাস্টিক দানার দোকান রয়েছে। এছাড়া ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় প্লাস্টিকের খেলনা ও পলিথিনের গোডাউন এবং কারখানা।

এর মধ্যে বরিশাল হোটেলের ওপরে একটি ফলস সিলিং তৈরি করে কাঠের পাটাতনের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে ঘুমানোর জায়গা ছিল নিহতদের। এই পাটাতনে হোটেল বরিশালের দুই শিফটের স্টাফরা পালাবদল করে ঘুমাতেন। পাটাতনটি হোটেলের চুল্লির ঠিক ওপরে। পাটাতনটি থেকে নামার একটি রাস্তা আছে, ভবনের সঙ্গে লাগানো একটি লোহার চিকন সিঁড়ি। এছাড়া পাটাতনটিতে আর কোনো দরজা বা জানালা ছিল না।

সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, আগুন লাগার শুরুতে নিহতরা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। পরে তাদের অনেকে আগুন দেখে উঠলেও বদ্ধ প্রকোষ্ঠের কারণে বের হতে পারেননি। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়।

এ বিষয়ে নিহত স্বপন সরকারের চাচাতো ভাই বাদশাহ সরকার বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ভাই ফোন দিয়ে বলে বাদশা আমার হোটেলে আগুন লেগেছে। এই কথা বলার পরই ভাইয়ের ফোন কেটে যায়। পরে আমি প্রথমে চকবাজার যাই। সেখানে ভাইকে না পেয়ে মিটফোর্ডে এসে জানতে পারি স্বপন ভাই আর নেই। সিআইডি আমাকে বলেছে, ভাই নাই। এখন ভাইয়ের লাশ নিয়ে কেমনে বাড়ি যাব।

এদিকে চকবাজারের কালামবাগের অগ্নিকাণ্ডে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় রুবেলের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী একটি মামলা করেছেন।

চকবাজার থানার উপপরিদর্শক রাজীব কুমার বিশ্বাস বলেন, এ ঘটনায় মোহাম্মদ আলী একটি মামলা করেছে। মামলায় ফখরুদ্দিনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া ভবন মালিক ও কারখানা মালিককে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

এমএসি/এমএইচএস