ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো. রাজ্জাক। মাসখানেক আগে কাছের এক আত্মীয়কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা নেন। সে সময় রোগীর সঙ্গে হাসপাতালে থাকার জন্য ২০০ টাকা (ফেরতযোগ্য) দিয়ে একটি এটেনডেন্ট (সঙ্গী) পাস করান রাজ্জাক। কিন্তু রোগীর চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর পাস কার্ডটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে না দিয়ে চলে যান তিনি। কিন্তু নিয়মানুযায়ী রোগীর চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ত্যাগের পূর্বে এই পাস কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে হয়। পক্ষান্তরে কর্তৃপক্ষকেও বুঝে নিতে হয় এটি।

রাজ্জাক ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘মাসখানেকের মতো হবে, রোগী ভর্তি করাইছি। ওই সময় ২০০ টাকা দিয়ে একটা পাস করাইছি। টাকাটা তুলতে আসছি। সকাল থেকে কয়েকবার টাকা চাইলে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ঘোরাচ্ছে। বলতেছে, পরে আসেন অ্যাকাউন্টে এখন টাকা নেই।’

রোগীর সঙ্গে থাকার জন্য নেওয়া পাস জমা দিয়ে টাকা ফেরত নিতে আসা সুমাইয়া আক্তারের ভাষ্যও একই। তিনি জানান, প্রায় দেড় মাস আগে তার মেয়েকে চিকিৎসা করানোর সময় পাস নিয়েছিলেন। সেই পাস আজই ফেরত দিতে এসেছেন।

বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার সঙ্গে কেউ থাকতে চাইলে ২০০ টাকা মূল্যের একটি এটেনডেন্ট পাস নিতে হয়। এক্ষেত্রে একজন রোগীর জন্য সর্বাধিক দুটি পাস সংগ্রহ করা যায়। এ পাস ছাড়া রোগীর সঙ্গে থাকা যায় না।

নিয়ম হচ্ছে, রোগীর চিকিৎসা শেষ করে হাসপাতাল ত্যাগের সময় এই পাস বহির্বিভাগে এবং জরুরি বিভাগের কাউন্টারে জমা দিতে হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজ্জাক-সুমাইয়ার মতো অনেকেই এই পাস ফেরত না দিয়ে চলে যান। এতে করে সরকারি এই সম্পত্তির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার পাশাপাশি রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনদের টাকাও গচ্ছা যাচ্ছে।

কাউন্টারে কথা বলছেন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এ রোগীরা/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে অবহেলার তথ্য পাওয়া গেছে। কেননা, ভর্তি হওয়া রোগী ছাড়পত্র পেতে গেলে কর্তৃপক্ষের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে যেতে হয়। নিয়মানুযায়ী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই পাস রেখে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলে এ বিষয়ে তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না।

এটেনডেন্ট পাস ইস্যুর দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ শুভ বলেন, ‘এত কিছু দেখার সময় আছে? এক সময় নি‌য়ে এলেই হ‌বে! কার্ড নি‌য়ে আসবে, টাকা দিয়ে দেব।’

ডাক্তার দেখাতে এসে ঠাঁই নিতে হয় মেঝেতে

বেলা সাড়ে ১০টা। ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে মেডিসিনের চিকিৎসক দেখানোর লাইনে দাঁড়িয়েই ঝিমুনি দিচ্ছেন এক রোগী। কয়েক মিনিট তার দিকে লক্ষ্য করে দেখা যায়, তিনি একটু পর পর চোখ বন্ধ করছেন। কিছু সময় অপেক্ষার পর কথা বলি তার সঙ্গে। জানান, টাঙ্গাইল থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। গত রাতে ঘুমাতে না পারায় এমন হচ্ছে।

ষাটোর্ধ্ব আব্দুল হামিদ নামের এ রোগী ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘গতকাল ডাক্তার দেখাইতে গ্রাম থেকে আইছি। সিরিয়াল পাইলাম না। এখানে থাকার মতো কেউ নেই দেইখা রাস্তায় থাকছি। অচেনা জায়গা, ঘুম আসে নাই বাবা। ডাক্তার দেখাইয়া বাড়ি যামুগা।’

ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগীরা/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

হাসপাতালের বহির্বিভাগের আশপাশের ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক দূর থেকে আসা লোকজন ডাক্তার দেখাতে না পেরে সড়ক কিংবা মেডিকেলের মেঝেতেই রাত কাটিয়ে দেন।

পাপ্পু নামের এক দোকানি বলেন, ‘কত লোক ডাক্তার দেখাইতে আইয়া সিরিয়াল না পাইয়া ফুটপাত বা মেডিকেলের বারান্দায় থাইকা যায়। কী করবে? গরিব মানুষ তো আর হোটেল ভাড়া কইরা থাকতে পারেন না।’

নারী দালালদের নিয়ে বিরক্ত রোগীরা

সকাল সাড়ে ৮টায় বহির্বিভাগের মূল ফটকের প্রবেশ পথেই দেখা মেলে বেশ কয়েকজন নারী দালালের। সরেজমিনে বেশ কিছু সময় তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কোনো রোগী মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই তাদের রোগ, টিকিট কেটে দেওয়া, আগে সিরিয়াল নিয়ে দেওয়াসহ ভালো জায়গায় সিট করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতার কথা বলে রোগীদের ত্যক্ত করছেন। হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের চোখের সামনেই এসব হতে থাকলেও তারা না দেখার ভান করে আছেন।

দালালদের এসব কাণ্ডে বিরক্ত এক রোগী বলেন, ‘আসার পর থেকে পেছন পেছন কয়েকজন নারী ঘুর ঘুর করছেন। বলছেন, সিট করে দেবে, আগে সিরিয়াল করে দেবে।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে এক আনসার কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদের (নারী দালাল) কেউই কিছু বলে না। তারা গরিব মানুষ, দুইটা টাকা রোজগার করে পরিবার চালায়। স্যাররা কিছু বলে না, আমরাও কিছু বলছি না।’

আলেয়া (ছদ্মনাম) নামের এক নারী দালাল জানান, তিনি ২০ বছর ধরে ঢামেক হাসপাতালে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। সকাল ৭টায় এখানে এসে সন্ধ্যা ৭টার পর বাসায় ফেরেন। তবে তার ভাষায়, ‘এটা দালালি নয়, রোগীদের সেবা’।

বহির্বিভাগে মেডিসিন ও গাইনি রোগীর সংখ্যা বেশি

সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে মেডিসিন ও গাইনি চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সংখ্যাই বেশি। রোগী এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই দুই বিভাগে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। অনেক সময় রোগীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের। এ দুই বিভাগের পর সবচেয়ে বেশি রোগী আসে শিশু এবং চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে।

মেডিসিন বিভাগে কথা হয় দাউদকান্দি থেকে আসা আফজার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, গতকাল দুপুর ১১টায় টিকিট কেটে সিরিয়াল নিলেও রোগীর ভিড়ের কারণে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয়নি। সেজন্য আজ ভোরেই লাইনে দাঁড়িয়েছেন।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুসন্তান শিমুকে নিয়ে আসা মা সেলিনা বেগম বলেন, ‘বাচ্চার নিউমোনিয়া হইছে। অনেক ডাক্তার দেখাইছি, কিন্তু ভালো হচ্ছে না। একজন পরামর্শ দিল, কষ্ট হলেও এখানে চিকিৎসা ভালো হয়; তাই বাচ্চাকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখাতে টিকিট মূল্য ১০ টাকা রাখা হচ্ছে। আর রোগী ভর্তি ফি রাখা হচ্ছে ১৫ টাকা।

সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতা দেখা গেলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে উদাসীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষকে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।

মেডিসিন ও গাইনি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ‘করোনা তো শেষ; এখন আর সামাজিক দূরত্ব কিসের?’

আব্দুল হালিম নামের এক রোগী বলেন, ‘ভাই রে যে ভিড়। এখানে সামাজিক দূরত্ব মানবো কেমনে? আর এখন করোনা তো তেমন দেখাও যায় না!’ আরেক রোগীর ভাষ্য, ‘গরিবের করোনা হয় না। সব বড় লোকেরা মরছে’।

এনআই/এফআর