বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এ টি এম সেলিম

বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এ টি এম সেলিমের বিরুদ্ধে। এমনকি তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপিসিতে চাকরি পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

নিয়োগে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তা সংস্থাটির যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে দুদকের অভিযোগ যাচাই-বাছাই সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকটি অভিযোগ সম্প্রতি দুদকে জমা হয়েছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ফাইল ঊর্ধ্বতন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত হলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে ৪ জন সহকারী ব্যবস্থাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিপিসি। নিয়োগ বোর্ড হিসাব বিভাগে চারজনকে নিয়োগ দেয়। এর মধ্যে নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাসের মাথায় মো. মনিরুল ইসলাম নামের একজন চাকরি ছেড়ে পূর্বের কর্মস্থল সিলেট গ্যাস ফিল্ডে যোগ দেন। শূন্য পদে তার চাচা বিপিসির তৎকালীন কোম্পানি সচিব কামাল উদ্দিনের হাত ধরে পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক পদে এ টি এম সেলিমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন প্রকল্প

মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন প্রকল্পেও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন এ টি এম সেলিম। প্রকল্পের শুরুতে ৫০ শতাংশ অগ্রগতি দেখিয়ে ম্যাক্সওয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস ও পাইপলাইন লিমিটেডকে বিল দেওয়ার মতো জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে অডিট রিপোর্টে।

প্রকল্পটির আরডিপিপির (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। খরচ করা হয়েছে ২০৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ কারণে অডিট প্রতিষ্ঠান খান ওয়াহাব শফিক রহমান অ্যান্ড কোম্পানি ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আপত্তি দিয়ে রেখেছে। প্রকল্পটির বেশ কিছু ভাউচারের হদিস পায়নি অডিট টিম।

অন্যদিকে, প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার বছর না পার হতেই অফিস ও আবাসিক ভবনের বারান্দায় ফাটল দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে অডিট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে অডিট আপত্তির বিষয়টি স্বীকার করে খান ওয়াহাব শফিক রহমান অ্যান্ড কোম্পানির চট্টগ্রাম অফিস।

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) প্রকল্পে দুর্নীতি

বিপিসির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের এসপিএম প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। এসপিএম প্রকল্পে জমি অধিযাচন নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। ধান ক্ষেতকে পানের বরজ দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ রয়েছে। ধান ক্ষেতের একরপ্রতি মূল্য ৩ লাখ, আর পানের বরজের মূল্য ৬৩ লাখ নির্ধারণ করে জমি অধিযাচনের সিদ্ধান্ত হয়। এতে প্রায় ৯৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকার দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে।

২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘুষের টাকা ভাগাভাগির সময় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ টাকাসহ ১ জনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। সেই সূত্র ধরে এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির ঘটনা উঠে এলেও মূল হোতা ডিজি সেলিম থেকে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

দুদকের অভিযোগে আরও বলা হয়, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলে দুর্নীতি বন্ধে বিপিসিতে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছে এ টি এম সেলিম চক্র। বিশেষ করে তেল বিক্রি ও মজুদ এক ক্লিকেই দেখা যেত। তাতে করে অধীনস্থ কোম্পানিগুলো ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারত না।

সেলিমের যত সম্পদ

অবৈধ সম্পদের বিষয়ে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক আবাসিক এলাকায় এ টি এম সেলিমের বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। হাজী আবদুল হামিদ রোডের ওই ভবনে (২/এ) স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকেন তিনি। ৭ কাঠা জমির ওপর নির্মিত বাড়িটির নাম রাখা হয়েছে শাশুড়ি জ্যোৎস্নার নামে। একজন চাকরিজীবী হয়েও ওই বাড়ি ছাড়াও চট্টগ্রাম ও রাজধানীতে ১০টির মতো ফ্ল্যাটের মালিকানা রয়েছে এ টি এম সেলিমের। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় তার বন্ধু আবদুল করিমের মাধ্যমে বাড়ি কেনা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এ টি এম সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।

আরএম/আরএইচ