চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সড়কবাতি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে নেওয়া প্রায় ২৬১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের বর্ধিত মেয়াদও শেষ হয়েছে। অথচ কাজই শুরু হয়নি। কাজ শুরু তো দূরের কথা, ঠিকাদারই নিয়োগ দিতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চসিক।

‘মডার্নাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল দুই বছর। সেই দুই বছর শেষে আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেই বর্ধিত মেয়াদ শেষ হয় গেল জুনে। এরপর চসিক ফের প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করে।

সর্বশেষ প্রস্তাব করাটা নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। তাই প্রকল্পটির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ৮ আগস্ট আইএমইডির সহকারী পরিচালক মো. আজগর আলীর সই করা এক চিঠিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এতে ব্যয় ধরা হয় ২৬০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে প্রকল্পের সংশোধিত বাস্তবায়নকাল এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়

একদিকে সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরবাসী। অন্যদিকে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন করে সময় বাড়ানোর আবেদন করায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এতে ব্যয় ধরা হয় ২৬০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে প্রকল্পের সংশোধিত বাস্তবায়নকাল এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ঘটনায় তিন আরএনবি সদস্য আটক

প্রকল্পসূত্রে জানা যায়, সোডিয়াম সড়কবাতির বদলে চসিকের ৪৬৬ কিলোমিটার সড়কে মোট ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি লাগানো হবে। এতে পোলসহ (ক্যাবল ও সার্ভার) প্রতিটি বাতির মূল্য ১ লাখ ৯ হাজার টাকা ধরা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা ভারতের এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেওয়ার কথা রয়েছে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারের বহন করার কথা রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে চসিকের বিদ্যুৎ বিল নেমে আসবে প্রায় অর্ধেকে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিড মহামারিসহ নানা কারণে প্রকল্পটির কাজ যথাসময়ে শুরু করা যায়নি। এ ছাড়া ভারতের এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া কর্তৃক পরিচালিত সক্ষমতা জরিপ (প্রি-কোয়ালিটি) প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে আট মাসের বেশি সময় লেগে গেছে। যার কারণে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া নিয়মকানুন মেনে বিভিন্ন কাজ শুরু করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে গেছে। প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগের শর্ত আরোপ নিয়মানুযায়ী না হওয়া ছাড়াও বেশ কিছু জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি।

সড়কবাতি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও কেন কাজ শুরু করা যায়নি—  এ প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পটির কাগজপত্র স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। শিগগিরই সিদ্ধান্ত দেবে। তখন এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব।

তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি আমার আমলে অনুমোদিত না। শুরুর দিকে বিভিন্ন কারণে ধীরগতি ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তাগিদ দিয়েছি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসে চসিকের সড়কবাতি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হলে ব্যয় বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় ২০ জুলাই। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ২০ দিন পর।

সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা (জুন ২০২২) পরিপত্রের অনুচ্ছেদ ৫.২.২ অনুযায়ী, প্রকল্পের কোনো ধরনের সংশোধন ব্যতিরেকে কেবল বাস্তবায়ন মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হলে প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ শেষের অন্তত তিন মাস আগে উদ্যোগী মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যৌক্তিক কারণসহ মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডিতে পাঠাতে হয়।

প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়নের সংশ্লেষ থাকলে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডির পাশাপাশি ইআরডিতেও পাঠাতে হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত  মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হলে তা অনুমোদনের জন্য সুপারিশ কিংবা প্রক্রিয়াকরণে বিধিনিষেধ রয়েছে।  

আরও পড়ুন: নামের মিলে ৬ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পেলেন জাসেদুল

এ পরিপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে, স্থানীয় সরকারের আওতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন ‘মডার্নাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো সংক্রান্ত মতামত দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ৮ আগস্ট আইএমইডি সহকারী পরিচালক মো. আজগর আলীর সই করা এক চিঠিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানানো হয়েছে, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের পরিপত্র অনুযায়ী প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর আইএমডি কর্তৃক সুপারিশ প্রদান করা গেল না।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিড মহামারিসহ নানা কারণে প্রকল্পটির কাজ যথাসময়ে শুরু করা যায়নি। এ ছাড়া ভারতের এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া কর্তৃক পরিচালিত সক্ষমতা জরিপ (প্রি-কোয়ালিটি) প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে আট মাসের বেশি সময় লেগে গেছে

তবে এ বিষয়ে এখনো কোন কিছু জানেন না বলে ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।

কাজ শুরুর বিষয়ে জানতে প্রকল্পটির পরিচালক চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের ফোনে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) সকালে কল দিলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটি মিটিংয়ে আছি। পরে ফোন দিন।’ এরপর কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফান্ড কখন আসবে, কীভাবে কাজ শুরু করবে— এসবের পরিকল্পনা ছিল না চসিক কর্মকর্তাদের। প্রজেক্ট শুরু করার আগে পুরো বিষয়ের একটি পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিকল্পনা মতো সবকিছু করার পর কাজ শুরু হবে। আমার মনে হয়, চসিক কর্মকর্তাদের অনীহা এবং অদূরদর্শিতার কারণে এ প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

তিনি বলেন, দেখা যায় কাজ শুরু হয় আগে, পরে পরিকল্পনা করে। অনিয়মকে নিয়ম করে ফেলে, যে কারণে এক বছরের একটি প্রজেক্ট পাঁচ বছর ধরে চলে। ফলে দেখা যায়, কাজের কোয়ালিটিও খারাপ হয়। কোয়ালিটি কীভাবে ঠিক রাখতে হয় তা—ও জানে না। 

কেএম/আরএইচ