প্রতীকী ছবি

দেওয়ানি আদালতে ভূমি ও পারিবারিক অপরাধের বিচারিক সেবা পেতে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে ৩৩ হাজার টাকার বেশি ঘুষ দিতে হয়।অন্যদিকে ফৌজদারি সংক্রান্ত অপরাধের বিচার পেতে সেবাগ্রহীতাদের ঘুষ দিতে হয় গড়ে প্রায় ১৯ হাজার টাকা। ঘুষের পরিমাণ হিসেবে ভূমি বা পারিবারিক মামলার বেশি লেনদেন হয়।  

ফৌজদারি আদালতের বিচার পেতে ৫৫ শতাংশের বেশি সেবাগ্রহীতাকে দুর্নীতির শিকার হতে হয়। যেখানে দেওয়ানি আদালতের সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হন ৪৮.৮ শতাংশ সেবাগ্রহীতা। আর উভয় আদালতে সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার হন ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা জরিপে উঠে এসেছে এসব চিত্র। বুধবার (৩১ আগস্ট) সেবা খাত নিয়ে খানা জরিপের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে সংস্থাটি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ওই খানা জরিপ চালায় তারা। দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে দেশের মোট ১৬টি খাত বিবেচনায় নিয়ে গ্রাম ও মহল্লাসহ মোট ১ হাজার ৩২০টি (গ্রামাঞ্চল-৮৩১টি, শহরাঞ্চল-৪৮৯টি) এলাকা নির্বাচন করে জরিপ কাজ পরিচালনা করে টিআইবি।

টিআইবির জরিপ বলছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের (সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত, ট্রাইবুনাল ইত্যাদি) আদালত বিদ্যমান। বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ বা অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলা পরিচালনা ও ন্যায়বিচার পেতে আইনি সেবা দেওয়া ব্যক্তিদের কাছে যেতে হয়। তবে মামলা পরিচালনার বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিচারপ্রার্থীদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আদালতে যেসব দুর্নীতির শিকার হতে হয় তার মধ্যে রয়েছে- আইনজীবীর উদ্দেশ্যমূলক সময়ক্ষেপণ, আইনজীবী ও মুহুরির অতিরিক্ত টাকা দাবি, সরাসরি ঘুষ, আইনজীবীর পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতা, আইনজীবী মামলা সম্পর্কে খোঁজ খবর না রাখা, দালালের মাধ্যমে হয়রানি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার।

সেবা গ্রহণের হার

জরিপে দেখা যায়, ৬ দশমিক ৩ শতাংশ খানা বিভিন্ন মামলার বিচার সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতে বিচারিক সেবা নিয়েছে। বিচারিক সেবা গ্রহণকারী খানার মামলাগুলো দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতে বিচারাধীন। সর্বোচ্চ সংখ্যক খানা ৬৬.১ শতাংশ দেশের বিভিন্ন জজ কোর্ট বা দেওয়ানি আদালত থেকে বিচারিক সেবা গ্রহণ করেছে। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বা ফৌজদারি আদালত থেকে সেবা নেওয়া খানার হার ২৯.৩ শতাংশ, উচ্চ আদালত থেকে সেবা নেওয়া খানার হার ১.৪ শতাংশ এবং বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনাল থেকে সেবা নেওয়া খানার হার ৪ শতাংশ।

অনিয়ম ও দুর্নীতি 

সার্বিকভাবে বিচারিক সেবা নেওয়া ৫৬.৮ শতাংশ সেবাগ্রহীতা বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের শিকার হয়েছেন। বিচারিক সেবাগ্রহণকারীর মধ্যে ২৩.৭ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছেন। যেখানে সেবাগ্রহীতারা গড়ে ১৯ হাজার ৯৬ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। খানাগুলোকে মামলা পরিচালনার জন্য ঘুষ বা অতিরিক্ত অর্থ ছাড়াও নানা ধরনের দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বিচারিক সেবাগ্রহণকারী খানার ৩৮.৯ শতাংশ আইনজীবীর উদ্দেশ্যমূলক সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে। এছাড়া নিয়োগ করা আইনজীবীদের মাধ্যমেও বিচারপ্রার্থীরা নানাভাবে দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। বিচারিক সেবাগ্রহণকারী খানাগুলোর ২৬.১ শতাংশ নির্ধারিত ফি দেওয়া সত্ত্বেও আইনজীবী ও মুহুরি অতিরিক্ত টাকা দাবি করে। এছাড়া আইনজীবীর সহকারী ও মুহুরির মাধ্যমে হয়রানির শিকার ২২.৯ শতাংশ, আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের অসহযোগিতার শিকার ১৭.৬ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

আদালত ভেদে দুর্নীতি 

ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট/জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকার ফৌজদারি আদালতে বিচারাধীন মামলা পরিচালনার জন্য যেসব খানা বিচারিক সেবা গ্রহণ করেছে তাদের ৫৫.৯ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। জজ কোর্ট বা দেওয়ানি আদালতে বিচারাধীন মামলা পরিচালনার জন্য যেসব খানা বিচারিক সেবা নিয়েছে তাদের ৪৮.৮ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। 
অন্যদিকে বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা পরিচালনার জন্য যেসব খানা বিচারিক সেবা নিয়েছে তাদের ৪৯.৩ শতাংশ এবং উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলা পরিচালনার জন্য যেসব খানা বিচারিক সেবা নিয়েছে তাদের ৪৪.৬ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি শিকার হয়েছে।

অপরদিকে জজ কোর্ট বা দেওয়ানি আদালতে বিচারাধীন মামলায় বিচারিক সেবা নেওয়া খানার ২১.৭ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে। যার গড় পরিমাণ ৩৩ হাজার ৭০৩ টাকা। একইভাবে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বিচারিক সেবাগ্রহণকারী খানার ২২.৬ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছে। যার গড় পরিমাণ ১৮ হাজার ৮৫৪ টাকা।

ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার কারণ 

জরিপে যেসব খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে তাদের ৮০.৭ শতাংশ বলেছে ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’। এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৮.৯ শতাংশ খানা ‘হয়রানি বা ঝামেলা এড়ানোর জন্য’ ও ৫৫.৭ শতাংশ খানা ‘যথাসময়ে সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য’, ২৭.৮ শতাংশ ‘নির্ধারিত ফি না জানার কারণে’, ২২.২ শতাংশ খানা ‘দ্রুত সেবা পেতে বা শুনানি করানোর জন্য’ ঘুষ দিয়েছে।

আরএ/জেডএস