সাত বছর আগে ২০১৫ সালে সেরা কলেজগুলোর র‌্যাংকিং শুরু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথবারই সেরাদের সেরার মুকুট ওঠে রাজশাহী কলেজের মাথায়। সেই শুরু, এরপর ২০১৬ ও ২০১৭ সালেও সেরা হয়েছে রাজশাহী কলেজ।

সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তাতেও সেরা রাজশাহী কলেজ। ৩১টি সূচক বিবেচনায় জাতীয় পর্যায়ে আটটি সেরা কলেজের মধ্যে রাজশাহী কলেজের অর্জন ৭০ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট। দেশের একমাত্র এই মডেল কলেজ সেরা সরকারি কলেজেরও খেতাব অর্জন করেছে এইবার।

বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে এই অর্জন উদযাপন করেছে রাজশাহী কলেজ। এ আয়োজনের মধ্যমণি ছিলেন সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক ছাড়াও এসময় কলেজের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক অংশ নেন এতে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।

কি মন্ত্র বদলে দিলো রাজশাহী কলেজকে? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ধরে রাখা, সর্বোচ্চ ক্লাস-পরীক্ষা, নিবীড় তদারকি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব কমে যাওয়ায় বদলে গেছে কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা।

আর এই পরিবেশ তৈরি করেছেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। গুণী এই শিক্ষাবিদ ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কলেজ থেকে অবসরে যান। তার দেখানো পথেই এগিয়ে যাচ্ছে রাজশাহী কলেজ।

হবিবুর রহমান রাজশাহী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট। যদিও বৃহৎবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রথম পা রাখেন ২০০১ সালের ৩ জুন। রসায়ন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ওই কলেজে যোগদান করেন তিনি। ২০০৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। তখনও ছিলেন রাজশাহী কলেজেই।

এরপর ২০০৯ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে রাসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ৫ মাস পর উপাধ্যক্ষ হিসেবে ফিরে আসেন রাজশাহী কলেজে।

প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান শুধু দক্ষ প্রশাসকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন জাত শিক্ষক। প্রশাসনিক দায়িত্বপালনের পাশাপাশি রসায়ন বিভাগে নিয়মিত ক্লাস ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নিতেন। একাডেমিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রম তদারকিও করতেন কঠোরভাবে। নিজের প্রজ্ঞা, মেধা ও একাগ্রতায় বদলে দেন রাজশাহী কলেজকে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রফেসর হবিবুর রহমান ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও নরওয়ের আধুনিক শ্রেণিকক্ষ ঘুরে আসেন। ফিরে এসে চালু করেন ‘স্টুডেন্ট সেন্টার্ড লার্নিং মেথড’ ক্লাসরুম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে নেন নানান উদ্যোগ।

ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চালু করেন ডিজিটাল অ্যালার্ট ও ভিজুয়্যাল অ্যাটেনডেন্স। শিক্ষার্থীদের জন্য তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাস, গ্রুপ ডিসকাশন ছাড়াও বাধ্যতামূলক করা হয় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও অ্যাসাইনমেন্ট। ক্লাসে উপস্থিতির জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়।

তার হাত ধরেই বদলে যায় পরীক্ষা পদ্ধতিও। বছরে দুটি ইনকোর্স নেওয়ার কথা থাকলেও প্রতি দুই মাস অন্তর ছয়টি ইনকোর্স পরীক্ষা নেওয়া হয়। ৬০ ভাগ ক্লাসে উপস্থিতি না থাকলে পরীক্ষা দিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা।

করোনা মহামারিকালেও পথ দেখিয়েছেন অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান। সরকারি নির্দেশনা আসার আগেই শুরু করেছেন অনলাইনে ক্লাস নেয়া। কেন্দ্রীয় পাঁচটি স্টুডিও থেকে সংকটকালে প্রায় ১১ হাজার ক্লাস হয়েছে। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণির প্রায় ৯৯৫টি, দ্বাদশ শ্রেণির ৬৫০টি, স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ৭ হাজার ২৫৯টি ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির ১ হাজার ৯৪৯টি ক্লাস হয়েছে।

পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, কমিউনিকেশন, লিডারশিপ এবং সফ্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান। বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক সংগঠনের পৃষ্টপোষকতা দিয়েছেন তিনি। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে চলছে এসব সংগঠন।

কলেজের ভৌত অবকাঠানো উন্নয়নে হাত দেন হবিবুর রহমান। ঐতিহ্য ধরে রেখে কলেজের বিভিন্ন একাডেমিক ভবন সংস্কার করেন।  উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ তলা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রাবাস’ নির্মাণ করেন। সংস্কার করেন মুসলিম ছাত্রাবাসের জরাজীর্ণ সাতটি ভবন। সংস্কার করা হয় হিন্দু ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস।

রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজশাহী কলেজ সব সময় শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। আজকের এই সাফল্যের পেছনে সাবেক অধ্যক্ষের বড় ভূমিকা রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাফল্যের মাত্রাকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে কাজ চলছে। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলের হাত ধরেই আজকের রাজশাহী কলেজের যাত্রা। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় ১৮৭৮ সালে প্রথম গ্রেড মর্যাদা পায় কলেজটি। রাজশাহী কলেজ নামকরণ হয় তখনই।

উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর ওই বছরই চালু হয় বিএ কোর্স। এরপর ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স। যদিও ১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরও অধিভুক্ত হয়। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমও। ছাত্র নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী এখন প্রায় ৩২ হাজার।

এমএএস