দুই বছর আগে করোনা মহামারির কঠিন সময় দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশে আসেন ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে সেদিন সম্পর্ক উন্নয়ন এবং অংশরীদারিত্ব বাড়ানোর বার্তা দিয়েছিলেন ভারতীয় এ দূত।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা রয়েছে তার। ৭১২ দিনের বাংলাদেশ মিশনে সম্পর্ক উন্নয়ন, অংশরীদারিত্ব বাড়ানো, করোনা মোকাবিলায় ভারতের টিকা বাংলাদেশে প্রবেশ করানো, করোনায় কারণে দুই দেশের বন্ধ যাতায়াত ব্যবস্থা চালু ; বিশেষ করে সড়ক-রেল ও বিমান যোগাযোগ চালুতে অবদান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ (সাবেক) এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর এবং শেষ মুহূর্তে তথা ঢাকা ছাড়ার আগে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফর করাতেও দোরাইস্বামীর অবদান রয়েছে বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতীয় হাইকমিশনার দোরাইস্বামী চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনে আসেন। করোনা মহামারির কঠিন সময়ে ঢাকায় এসে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন তিনি। তার সময়ে দুই দেশে উচ্চ পর্যায়ে সফর বিনিময় হয়। এসব সফর ঢাকা-নয়াদিল্লির সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

২০১৯ সালের শেষের দিকে ভারতের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) এবং পরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পার্লামেন্টে উত্থাপন নিয়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে অস্বস্তি দেখা দেয়। সে সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ ক্ষমতাসীন বিজেপির আরও কয়েকজন নেতার এনআরসি ও সিএএ সংশোধনী আইন নিয়ে করা মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি ঢাকা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইকমিশনার দোরাইস্বামী করোনা মহামারির কঠিন সময়ে বাংলাদেশে আসেন। কঠিন সময়ে খুব ভালোভাবেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হয়েছেন। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করার পাশাপাশি করোনার মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের (সাবেক) প্রথম সফর ছিল বাংলাদেশে। একই বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করে। হাইকমিশনারের দায়িত্বের শেষ সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করলেন। এসব উচ্চ পর্যায়ে সফরে দোরাইস্বামীর অবদান রয়েছে।

স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পর ঢাকায় বিদায়ী দোরাইস্বামীসহ ১৭জন ভারতীয় হাইকমিশনার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ হাইকমিশনার ঢাকায় দুই বছরের বেশি সময় নয়াদিল্লির দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে সবশেষ হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশের ক্ষেত্রে। রীভাকে দেড় বছর ঢাকায় দায়িত্ব পালন শেষে নয়াদিল্লিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

বিদায়ী হাইকমিশনার দোরাইস্বামী প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করে নয়াদিল্লি ফিরে যাচ্ছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে ভারতের পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এবং শিগগিরই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো বলছে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে ভারতের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) এবং পরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পার্লামেন্টে উত্থাপন নিয়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে অস্বস্তি দেখা দেয়। সে সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ ক্ষমতাসীন বিজেপির আরও কয়েকজন নেতার এনআরসি ও সিএএ সংশোধনী আইন নিয়ে করা মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি ঢাকা। তবে খোলামেলা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য কিংবা কোনো অস্বস্তি প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ সরকার। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য ছিল, দুই দেশের সম্পর্কে অন্য কোনো বিষয়ের প্রভাব পড়বে না।

আরও পড়ুন : ‘নির্বাচন নিয়ে দিল্লির সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন দেখছি না’

ভারতের এনআরসি ও সিএএ সংশোধনী আইন নিয়ে ঢাকা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এর প্রভাব দেখা দেখা যায়, সরকারের মন্ত্রীদের ভারত সফর বাতিলের মধ্যে দিয়ে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের আমন্ত্রণে দেশটি সফর বাতিল করেছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বাতিলের একদিন পর ভারত সফর বাতিল করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। সে সময় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার আমন্ত্রণে দেশটি সফর করার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন রাইসিনা সংলাপে যোগ দেওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ারও ভারত সফর বাতিল করেন।

সে সময় ঢাকায় ভারতের দূতের দায়িত্বে ছিলেন রিভা গাঙ্গুলী। ভেতরে ভেতরে দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের সম্পর্কের টানাপোড়নের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে ঢাকায় দূত করার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার বিক্রম দোরাইস্বামীকে নির্বাচিত করে।

আরও পড়ুন : না বুঝে ফাঁদে পা দিচ্ছেন মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুরা

ঢাকায় দূত হয়ে দোরাইস্বামী ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশে প্রবেশের তিন দিনের মাথায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন হাইকমিশনার দোরাইস্বামী। পরিচয়পত্র পেশ করার পরদিনই ঢাকা মিশনে নেমে পড়েন দোরাইস্বামী। মাস-খানেকেরও কম সময়ের মধ্যে করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মন্ত্রীসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্ব শেষ করেন তিনি। এরপর থেকে যোগাযোগ বা সাক্ষাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন দোরাইস্বামী। একের পর এক ছুটে গেছেন আমলা, মন্ত্রী ও সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে। যা এর আগে ঢাকায় দায়িত্ব নিয়ে আসা বিদেশি দূতদের করতে দেখা যায়নি। এ সময়ে দুই দেশের মন্ত্রীদেরও সফর বিনিময়ে জোর দিয়েছেন।  

এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতীয় হাইকমিশনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে দোরাইস্বামী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। তবে এটি এমন একটি সম্পর্ক যা সবচেয়ে মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক হৃদয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত। গত দশকে দুই দেশ একসঙ্গে অনেক মহৎ কাজ করেছে যা উদযাপন করার মতো। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের মধ্যে আত্মা ও হৃদয়ের সংযোগ আছে এবং তা রক্তের সম্পর্কের থেকেও বেশি কিছু। আমরা সব সময় এই সম্পর্ককে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, আমরা তোমাদের আত্মীয় এবং তোমরা আমাদের আত্মীয়। তাই একে অপরের কাছে অনেক সময় অবাস্তব প্রত্যাশাও থাকতে পারে।

গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দোরাইস্বামী জানান, ঢাকায় দায়িত্ব পালন করতে এসে অর্জিত অভিজ্ঞতা চিরকাল স্মৃতিতে লালন করবেন।

নতুন হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা আসছেন ২১ সেপ্টেম্বর

দায়িত্ব পালন করতে আগামী বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় আসার কথা রয়েছে ভারতীয় নতুন হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

তিনি জানান, বিদায়ী হাইকমিশনার দোরাইস্বামী দুই একদিনের মধ্যে চলে যাওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে নতুন হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা আগামী ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার আসার কথা রয়েছে।

প্রণয় কুমার ভার্মা

গত ২৯ জুলাই ভার‌তের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ও‌য়েবসাইটে প্রকাশ করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হ‌য়ে‌ছে, বর্তমানে ভিয়েতনামে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় কুমার ভার্মাকে বাংলাদেশের পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেবেন।

প্রণয় কুমার ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত হওয়ার আগে তি‌নি ভার‌তের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পূর্ব এশিয়া বিভাগে নিয়োজিত ছিলেন। তার আগে এ কূটনীতিক ভারতের পরমাণু কূটনীতিক হিসেবে অ্যাটমিক এনার্জিতে কাজ করেন।

আরও পড়ুন : রুটিন কূটনীতি নয়, প্রতিবেশীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক চায় ঢাকা

১৯৯৪ সালে ভার‌তের ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়া প্রণয় কুমার কূটনীতিক হিসেবে হংকং, সানফ্রানসিস্কো, ওয়াশিংটন ডিসি ও কাঠমান্ডুতে বিভিন্ন প‌দে দা‌য়িত্ব পালন ক‌রেন।

১৭ ভারতীয় দূতদের কে কতদিন ছিলেন ঢাকায়

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিদায়ী হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীসহ এ পর্যন্ত ১৭ জন ভারতীয় দূত ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি সময় চার বছর করে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনজন হাইকমিশনার। তারা হলেন-আই এস চাড্ডা, কৃষ্ণা শ্রী নিবাস ও দেব মুখার্জি।

আর সবচেয়ে কম সময় ছিলেন রীভা গাঙ্গুলী দাশ (দেড় বছর)। এরপর সবচেয়ে কম সময় হতে যাচ্ছেন বিদায়ী হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী (৫ অক্টোবর ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর-২০২২)।

ঢাকায় প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন সুবিমল দত্ত (১৯৭২-১৯৭৪), এরপর ঢাকায় আসেন এস সেন (১৯৭৪-১৯৭৬), কে পি এস মেনন (১৯৭৭-১৯৭৯), মুচকুন্দ দুবে (১৯৭৯-১৯৮২), আই পি খোসলা (১৯৮২-১৯৮৫), আই এস চাড্ডা (১৯৮৫-১৯৮৯), কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন (১৯৮৯-১৯৯২), কে রগুনাথ ১৯৯২-১৯৯৫), দেব মুখার্জি (১৯৯৫-২০০০), এম এল ত্রিপাটি ২০০০-২০০৩, ভিনা শিকরি (২০০৩-২০০৬), পি আর চক্রবর্তী (২০০৭-২০০৯), রাজিত মিত্র (২০০৯-২০১১), পঙ্কজ স্মরণ (২০১২-২০১৫), হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা (২০১৬-২০১৯), রীভা গাঙ্গুলী দাশ (২০১৯ মার্চ থেকে ২০২০ সেপ্টেম্বর) এবং বিদায়ী হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।

এনআই/এসকেডি