চট্টগ্রামে মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এলিট ফোর্সটির দাবি, তিনি একজন প্রতারক। প্রতারণার জন্য তিনি নানা কৌশলের আশ্রয় নিতেন। 

র‍্যাব বলছে, জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবসায় অংশীদার করার আশ্বাসে, স্বর্ণ-ডায়মন্ড থাকার কথা বলে, এক জমি অনেকের কাছে বিক্রি করে এবং মন্ত্রী-উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

এমনকি প্রতারণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে আড়ালে ঢাকতে মেজবাহ করেন হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট। এ ছাড়া তিনি ঘনঘন সিমও বদলে ফেলতেন।  

সোমবার ( ১৯ সেপ্টেম্বর) চান্দগাঁও ক্যাম্পে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ।

তিনি বলেন, মেজবাহর বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাটে। তার বাবা স্থানীয় একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। মেজবাহ গত কয়েক বছরে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

মেজবাহ এইচএসসি পাস। তিনি ১৯৯৮ সালে জাহাজের স্ক্র্যাপের ব্যবসায় জড়িত হন। শুরুতে অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে লাভবান হয়। পরে বিভিন্নজনকে পার্টনার করে টাকা-পয়সা নেন। ২০০৮ পর্যন্ত ব্যবসা ভালো চলতে থাকে।

২০০৮ সালের পর মেজবাহ ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন, তা ফেরত দিতে না পেরে চাপে পড়েন। তখন তার মাথায় প্রতারণার বিষয়গুলো চলে আসে। এরপরই প্রতারণার আশ্রয় নেন মেজবাহ। 

অল্প সময়ের মধ্যে ধনী হওয়ার চিন্তা তার মাথায় ঢুকে যায়। ২০১৪ সালে লোকজনকে জাহাজের ছবি দেখিয়ে নিজে সেটি কিনেছেন বলে তাদের জানান। এরপর জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবসায় অংশীদার করার কথা বলে অনেক টাকা হাতিয়ে নেন।

র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, মেজবাহকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রতারণায় তাকে সার্বিক সহযোগিতা করত পরিবার। এ কাজের জন্য তিনি ভাইদের কাছ থেকে বড় ধরনের সহায়তা পেয়েছেন।   

প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা মেজবাহ কী করেছেন— জানতে চাইলে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতারক মিজবাহর চান্দগাঁওয়ে তিনতলা বাড়ি ও হালিশহরে জমি রয়েছে। এ ছাড়া তার স্ত্রীর নামে কিছু সম্পত্তি করেছেন বলে মেজবাহ স্বীকার করেছেন।

প্রতারণার মাধ্যমে মেজবাহ বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে কী কী করেছেন— সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানা যায়নি। র‍্যাব মনে করছে, ভাইয়েরা তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। তার ভাইয়েরা তেমন কিছুই করেন না। ভাইদের সম্পদ ও প্রতারণায় তাদের সংশ্লিষ্টতা বের করার চেষ্টা করা হবে। সব কিছু মিলিয়ে র‍্যাবের মনে হয়েছে, মেজবাহ উঁচু পর্যায়ের প্রতারক।

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সাল থেকে প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া শুরু হয়। গত সাত বছরে কয়েকশ সিম ব্যবহার করেছেন মেজবাহ। চট্টগ্রাম বা ঢাকায় তার স্থায়ী নিবাস ছিল না। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১১টি প্রতারণা মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। 

জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবসায় অংশীদার করার কথা বলে প্রতারণা 

জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবসা করায় মেজবাহর এ ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা ছিল। র‍্যাব বলছে, শত কোটি টাকার পুরানো একটি জাহাজকে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রির জন্য সীতাকুণ্ডের কুমিরার সমুদ্র উপকূলবর্তী খাজা শিপইয়ার্ডে আনা হয় ২০১৪ সালে। কয়েক মাসের মধ্যে এরকম আরও কয়েকটি জাহাজ আনার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্যবসায় অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দেন প্রতারক মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী।

এ কাজে সহযোগী হিসেবে তিনি ২০-২৫ জন লোককে মাসিক বেতনে রাখতেন। তারা ভুক্তভোগীদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং তার কাছে সরবরাহ করতেন। ভুক্তভোগীরা যখন এ ব্যবসা সম্পর্কে আশপাশের লোকজনের কাছে খোঁজ নিতেন, তখন তারা তাদের জানাতেন মেজবাহ ভালো মানুষ এবং ব্যবসার সবকিছুই ঠিক আছে।

মেজবাহ পর্যায়ক্রমে ও ধাপে ধাপে ভুক্তভোগী আব্দুল হাকিমের ২ কোটি ২০ লাখ, আজগর আলীর ৭০ লাখ, মো. রেজওয়ানের ৪০ লাখ, ইব্রাহিমের ২০ লাখ, মো. রুমানের ৬৩ লাখ, শহিদুল ইসলামের ৯০ লাখ, জাহিদুল ইসলামের ৫০ লাখ, আসাদের ৫০ লাখ, বেলালের ৫০ লাখ ও শাহজাহানের ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মেজবাহ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, মেজবাহ ২০১৪ সালে জাহাজটি নিজে কিনেছেন বলে ভুক্তভোগীদের জানান। এরপর সেটি স্ক্র্যাপের জন্য নেওয়া হবে বলে জানান। এরপর লাভের টাকা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন বলে আশ্বাস দেন। এভাবেই তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে জাহাজ স্ক্র্যাপ ব্যবসার পার্টনার বলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। 

স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের কথা বলে প্রতারণা

জাহাজ স্ক্র্যাপ ব্যবসার পার্টনারশিপ দেওয়ার কথা বলে মেজবাহ যাদের কাছে থেকে টাকা নিয়েছিলেন, তারা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকলে তখন তিনি নতুন গল্প নিয়ে আসেন। এরপর তিনি স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের গল্প সামনে নিয়ে আসেন।

র‍্যাব বলছে, প্রতারক মিজবাহ বাজেয়াপ্ত কনটেইনার ভুক্তভোগীদের দেখিয়ে প্রচার করেন যে, তিনি প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ পেয়েছেন। এ স্বর্ণ তিনি প্রায় ৫০০ কোটি টাকায় বিদেশে বিক্রি করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ টাকা সিজ করেছে। এ ছাড়াও তিনি পাঁচটি ডায়মন্ড পেয়েছেন, যার প্রতিটির মূল্য দুই হাজার কোটি টাকা।

স্বর্ণ ও ডায়মন্ড বিক্রির টাকা পেতে বিভিন্ন মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভাগ দিতে হবে বলেও প্রচার করেন মেজবাহ। এ প্রচারণা চালিয়েও তিনি প্রতারণা করেন। প্রতারক মেজবাহ ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের কণ্ঠ নকল করে কথোপকথনের রেকর্ড শোনাতেন ভুক্তভোগীদের।

র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, প্রতারণা করার জন্য যা যা করা দরকার, সবকিছুই মেজবাহ করেছেন।

জমি বিক্রির কথা বলে প্রতারণা

প্রতারক মেজবাহ এক জমি বিভিন্নজনের কাছে বিক্রির কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নগরের বাড়াইপাড়া এলাকায় একটি জমি তিনি ভুয়া দলিল দেখিয়ে অন্তত ১০ জন ভুক্তভোগীর কাছে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা

প্রতারক মেজবাহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে তার ব্যবসার শেয়ার দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে নিতেন। পরে তাদের কোম্পানি শেয়ারের টাকার লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ব্যাংকের চেক দিতেন।

ভুক্তভোগীরা চেক নিয়ে ব্যাংকে গেলে দেখা যেত তার চেকের বিপরীতে অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ভুক্তভোগীরা পাওনা টাকা চাইলে তিনি পূর্বে সংরক্ষিত সই জালিয়াতি করে বিভিন্ন ভুয়া দলিল দস্তাবেজ তৈরি করে তাদেরই উল্টো মিথ্যে মামলার ভয় ও মামলা করে নাজেহাল করতেন। মিথ্যা মামলার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগীই পাওনা টাকার বিষয়ে মুখ খোলার সাহস করতেন না।

নিজেকে আড়াল করতে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও সিম পরিবর্তন

র‍্যাব বলছে, মিজবাহকে যেন ভুক্তভোগীরা সহজে খুঁজে না পান, সেজন্য তিনি নিজ জেলার স্থায়ী ঠিকানায় অবস্থান না করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করতেন। এ ছাড়া সে তার একাধিক মোবাইলে ঘন ঘন সিম পরিবর্তন করতেন, যাতে তার সঙ্গে কেউ সহজে যোগাযোগ করতে না পারে। বর্তমানে তাকে যাতে চিনতে না পারা যায়, সেজন্য তিনি হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন। মেজবাহর ২০০৮ সালের চেহারার সঙ্গে বর্তমান চেহারার অনেক পার্থক্য রয়েছে।

যেভাবে র‍্যাবের জালে প্রতারক মেজবাহ

র‍্যাব-৭ অধিনায়ক এম এ ইউসুফ বলেন, অনেকদিন ধরে তাকে (মেজবাহ) গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছিলাম। এ জন্য র‍্যাবের প্রধান অফিসের গোয়েন্দা শাখার সাহায্য নিই। একবার ভেবেছিলাম মেজবাহ হয়তো বিদেশে চলে গেছেন। তাকে ট্রেস করতে পারছিলাম না। গত সাত বছরে কয়েকশ সিম ব্যবহার করেছেন তিনি। এক সিম বেশিদিন রাখতেন না।

রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে গোয়েন্দা তথ্যে প্রতারক মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানার হামজারবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সেখানে তার বোনের বাসায় ছিলেন।  

প্রতারণার কথা নিজ মুখে অকপটে স্বীকার করেছেন মেজবাহ। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও জানান। চট্টগ্রামে এলে গ্রেপ্তার এড়াতে ভাই-বোনদের বাসায় থাকতেন তিনি।

র‍্যাব বলছে, মেজবাহর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং কোতোয়ালি থানায় প্রতারণার ২২টি মামলা পাওয়া যায়। আদালত ১১টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন। বাকি মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন।

কেএম/আরএইচ