বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। এই বাড়তি দাম জনজীবনে বাড়তি চাপ হয়ে ভোগান্তি নিয়ে এসেছে। নিত্যপণ্যের সঙ্গে দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যেরও। নির্মাণসামগ্রীর অপরিহার্য উপকরণ বাঁশের দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।

চাহিদা থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বাঁশের বাজার ও দোকান। বিশেষ করে মেরুল বাড্ডা, মেরাদিয়া, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড, কল্যাণপুর ও নতুন বাজার এলাকায় বাঁশের বড় বড় বাজার ও দোকান গড়ে উঠেছে। এসব বাজার  ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় বাঁশের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, মূলত সরবরাহ কম থাকার পাশাপাশি পরিবহন খরচ আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর বাঁশের বাজারে দামের প্রভাব পড়েছে। তারা বলছেন, কিনতেই  হচ্ছে বেশি দামে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।

মেরুল বাড্ডা, মেরাদিয়া, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড, কল্যাণপুর ও নতুন বাজার এলাকায় বাঁশের বড় বড় বাজার ও দোকান গড়ে উঠেছে। এসব বাজার  ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় বাঁশের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে

রাজধানীতে বাঁশের চাহিদা কেমন

গ্রামগঞ্জে বাঁশের ব্যাপক ব্যবহার হলেও শহরে কিছুটা ভিন্ন। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের ভবন নির্মাণকাজে বাঁশের ব্যবহার আগে থেকেই রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি কবরে ব্যবহার করতে হয় বাঁশ। অন্যদিকে, ফার্নিচার ও কারুশিল্পে তো বাঁশের ব্যবহার আছেই।

রাজধানীর বিভিন্ন বাঁশের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বরাক, মূলী, রেঙ্গুনি, দুলা, টেংরি, মাহালসহ বিভিন্ন জাতের বাঁশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে, বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা বরাক বাঁশের। এসব বাঁশের বেশিরভাগ আসে টাঙ্গাইল, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরা থেকে।

আরও পড়ুন >> সুস্বাদু পাহাড়ি খাবার বাঁশ কোড়ল

রাজধানীর শান্তিনগর থেকে মেরুল বাড্ডার বাজারে বাঁশ কিনতে এসেছেন নির্মাণাধীন একটি ভবনের কনট্রাক্টর আব্দুর রাজ্জাক মিয়া। তিনি বলেন, প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। সাধারণত সব ধরনের বাড়ি বা ভবনে ঢালাইয়ের সময় বাঁশ খুঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়। ভবনের নির্মাণকাজে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ লাগে। পাঁচতলা-দশতলা যা-ই হোক ভেতরে বা বাইরে, প্রতিটি ফ্লোরে মাচা তৈরি করতে হয় বাঁশ দিয়ে। সেই সঙ্গে এগুলোর খুঁটি হিসেবেও বাঁশের ব্যবহার হয়।

রাজধানীর বনানী কবরস্থানে কবর খোঁড়া ও রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত কর্মী আকরামুল ইসলাম বলেন, কবর দেওয়ার সময় বাঁশ অপরিহার্য। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে এই বাঁশ কিনতে হয়।

রাজধানীতে বাঁশের বর্তমান দর

রাজধানীর বাঁশের বিভিন্ন বাজারে ক্রেতা মূলত রাজধানীবাসী। নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে এসব বাঁশ কিনতে বাজারগুলোতে যান তারা। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক বিভিন্ন বাজার ঘুরে বাঁশের দাম জানার চেষ্টা করেছেন।

মেরুল বাড্ডার বাঁশবাজারের বিক্রেতা লতিফুর রহমান বলেন, ভালো মানের বাঁশ এখন পাওয়াই মুশকিল। এর মধ্যে বরাক বাঁশের চাহিদা রাজধানীতে বেশি। কারণ, এগুলো অনেক শক্ত হয়। গিট বেশি থাকে, ভেতরে ফাঁপা কম। ফলে নির্মাণাধীন ভবনে এই বাঁশ ব্যবহার হয় বেশি। ৩৫ থেকে ৪৫ ফুটের বরাক বাঁশ প্রতি পিস আমরা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করি। কিছুদিন আগেও যা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হতো।

আরও পড়ুন >> ২ কোটি টাকার সেতুতে বাঁশ

শনির আখড়ার বাঁশ-বিক্রেতা কাউছার মিয়া বলেন, সব ধরনের বাঁশের দামই বাড়তি যাচ্ছে। ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা প্রতি পিস, এমন বাঁশের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া নির্মাণকাজ যখন বেশি চলে, মূলত সেই সময়ে বাঁশ বিক্রি বেড়ে যায়। চাঁটাই-বেড়া তৈরির কাজে ব্যবহৃত বাঁশগুলো তুলনামূলক কম মজবুত অর্থাৎ মোটা না হলেও চলে। এসব বাঁশের দাম তুলনামূলক কম।

একই এলাকার অপর বাঁশ-বিক্রেতা রাসেল সরদার বলেন, আগে আমরা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বাঁশ বিক্রি করেছি। এখন দাম বেড়ে গেছে।

রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকার বাঁশ-ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতা নাইমুল ইসলাম বলেন, আগে যে বাঁশ ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হতো, সেই বাঁশ এখন ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝে একই বাঁশ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে।

বাঁশের বাড়তি দামে ক্ষুব্ধ ক্রেতা

মগবাজার এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ভবনের কাজের জন্য মেরুল বাড্ডার বাজারে বাঁশ কিনতে এসেছেন মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, মগবাজার এলাকায় আমার আরও একটি বাড়ি আছে। কয়েক বছর আগে করা। সেই বাড়ি নির্মাণের সময় ব্যবহৃত বাঁশগুলো গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কিনেছিলাম। আজ যখন নতুন বাঁশ কিনতে এসেছি, তখন একেকটি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে চাচ্ছেন বিক্রেতারা। এত দামে কি বাঁশ কেনা যায়? এসব বাঁশ যত ভালোই হোক, সর্বোচ্চ দুবার ব্যবহার করা যায়। তাই এত দাম দিয়ে বাঁশ কীভাবে কেনা সম্ভব? যে কারণে অন্য বাজারে দাম দেখতে এসেছি।

আরও পড়ুন >> ঢাকার বাজারে বাঁশশিল্পের কদর থাকলেও ভালো নেই শ্রমিকরা

গুলশানে একটি ভবন নির্মাণের কাজ নিয়েছেন নিমাই চন্দ্র নামের এক রাজমিস্ত্রি। বাঁশের বাজারে আলাপ হয় তার সঙ্গে। বলেন, আগে কম দামে বাঁশ কিনতে পারলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবনে ব্যবহারের জন্য তুলনামূলক ভালো মানের বাঁশ লাগে। ৩৫ থেকে ৪৫ ফুট লম্বা ও মজবুত বাঁশ কিনতে গেলে বিক্রেতারা ৫০০ টাকা করে দাম চাচ্ছেন। এত দামে বাঁশ কিনে পোষাতে পারব না।

‘রাজধানীর প্রতিটি বাঁশের বাজারে একই ধরনের দাম নির্ধারণ করে রেখেছেন বিক্রেতারা। মেরুল বাড্ডার বাজারে প্রায় সাতটি বাঁশের দোকান রয়েছে। তারা সবাই একই ধরনের দাম চাচ্ছেন। তাদের মতে, ভালো মানের বাঁশ কিনতে হলে প্রতি পিস ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা লাগবে।’

বাড়তি দাম নিয়ে যা বলছেন বিক্রেতারা

বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় বাঁশের সরবরাহ অনেক কম। এছাড়া ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। ফলে বাঁশের দামও বাড়তি।

মেরুল বাড্ডার বাঁশ-বিক্রেতা লতিফুর রহমান বলেন, বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ার যৌক্তিক কিছু কারণ আছে। প্রথমত, গ্রামগঞ্জে এখন বাঁশের ঝাড়ের সংখ্যা কমেছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন অর্থাৎ ট্রাকের ভাড়াও বেড়েছে। আগের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে পরিবহনে।

শনির আখড়ার বাঁশ-বিক্রেতা রাসেল সরদার বলেন, উত্তরবঙ্গের কোনো জেলা থেকে ট্রাকে আড়াইশো পিস বাঁশ আনতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। এক ট্রাকে ২৫০ থেকে ৩০০ পিস বাঁশ ধরে। কেনাও পড়ে বেশি দামে। ফলে ঢাকার বাজারে বেড়ে যাচ্ছে বাঁশের দাম।

সাইনবোর্ড এলাকার বাঁশ-ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতা নাইমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সোজা, লম্বা ও মজবুত বাঁশের সরবরাহ কম। আগে গ্রামগঞ্জে যেসব জায়গায় বাঁশঝাড় ছিল, এখন সেখানে বাড়ি-ঘর উঠে যাচ্ছে। গ্রামে ফাঁকা বা বাঁশঝাড়ের জায়গা এখন আর কেউ রাখছেন না। ফলে উৎপাদন কম, সরবরাহও কম।

এএসএস/আরএইচ/এমএআর/