উত্তরা দিয়াবাড়ীতে বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৩ এর কার্যালয় | ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘এত ভয় পাওয়ার কী আছে? আপনাকে একবারে টাকা দিতে হবে না, তিন কিস্তিতে দেবেন। এক ধাপের কাজ হবে, পরের ধাপের টাকা জমা দেবেন। আমরা তো এগুলো করেই খাই। আমরা কখনও হারিয়ে যাব না।’

ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা রিয়াদুল ইসলামকে (ছদ্মনাম) এভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছিলেন হজরত আলী নামের এক দালাল (টাকার বিনিময়ে লাইসেন্সের কাজ করে দেন)। হালকা ও মাঝারি যান চালানোর অনুমতির সনদ পেতে তার এখানে আসা।

ড্রাইভিং লাইসেন্স দরকার কিন্তু তেমন কিছুই জানেন না; কীভাবে, কী করতে হয়। এ অবস্থায় অনেকটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন রিয়াদুল। কী করবেন, চিন্তার ছাপ মুখে ফুটে উঠতে দেখে অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে হজরত আবারও বলতে থাকেন, ‘এসব অনলাইন, সিস্টেম— সবকিছুই ভুয়া। একা করতে গেলে বছর পার হয়ে যাবে কিন্তু লাইসেন্স পাওয়া হবে না। আমরা এখানে আপনাদের সুবিধার জন্যই কাজ করি। শত শত মানুষ আমাদের থেকে লাইসেন্স করে নিয়ে যাচ্ছে। আপনাকে তো নিশ্চয়তা দিলামই, একবারে টাকা দিতে হবে না।’

এসব অনলাইন, সিস্টেম— সবকিছুই ভুয়া। একা করতে গেলে বছর পার হয়ে যাবে কিন্তু লাইসেন্স পাওয়া হবে না। আমরা এখানে আপনাদের সুবিধার জন্যই কাজ করি। শত শত মানুষ আমাদের থেকে লাইসেন্স করে নিয়ে যাচ্ছে। আপনাকে তো নিশ্চয়তা দিলামই, একবারে টাকা দিতে হবে না

হজরত আলী, দালাল

রিয়াদুলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দালাল হজরত আস্থা বাড়ানোর জন্য পাশে থাকা ফটোকপির দোকান (মামা-ভাগ্নে) দেখিয়ে বলেন, ‘চলেন, আমাদের দোকানে বসে কথা বলি। আমি হারিয়ে গেলে দোকান তো হারাবে না। আমার ভাই স্টেট-কাট কথা। নয় হাজার টাকা দেবেন, এক মাসের মধ্যে লাইসেন্স নিয়ে যাবেন।’

দিয়াবাড়ী বিআরটিএ কার্যালয় | ছবি- ঢাকা পোস্ট

গতকাল মঙ্গলবার (২ মার্চ) রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ী এলাকায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৩ এ মোটরসাইকেল লাইসেন্সের টাকা জমা দেওয়া বুথের সামনে লাইসেন্সপ্রত্যাশী ও দালালের মধ্যে এমন কথোপকথন চলে। পাশেই অবস্থান করছিলেন ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক।

কিছুক্ষণ পর ‘নতুন লাইসেন্স করব’— এমন প্রত্যাশার কথা জানালে দালাল হজরত বলেন, ‘ভাই, শুরুতে কেউ বিশ্বাস করে না। যখন কাজ শুরু হয় তখন যারা লাইসেন্স করতে আসেন তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা এখানে কয়েকজন কাজটা করি। বলে-কয়েই সব কাজ হয়।’

সরেজমিনে কেন্দ্রটি ঘুরে এমন অনেক দালালের দেখা পাওয়া গেল। অনেকে আবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনে (বিআরটিসি) কর্মরত। তারাও অনৈতিক সুবিধার আশায় ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দিচ্ছেন।

শুরুতে আমি নিজেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম অনেক ঝামেলা এবং সময় বেশি লাগে তখন আশরাফুল আলম নামের একজনকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিচ্ছি। আমার সঙ্গে আরও দুজন আছেন। নিজে করলে খরচ হতো দুই হাজার টাকার মতো। দালাল দিয়ে করাচ্ছি বলে ১০ হাজার টাকা লাগছে

সোহাগ হোসেন, লাইসেন্সপ্রত্যাশী

সোহাগ হোসেনসহ তিনজন এসেছেন ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে। প্রত্যেকেই সাড়ে ১০ হাজার টাকা করে বিআরটিসিতে কর্মরত আশরাফুল আলম নামের একজনকে দিয়েছেন। ঝামেলা ছাড়াই তাদের কাজ হচ্ছে বলে জানান সোহাগ। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমি নিজেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম অনেক ঝামেলা এবং সময় বেশি লাগে তখন আশরাফুল আলম নামের একজনকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিচ্ছি। আমার সঙ্গে আরও দুজন আছেন। নিজে করলে খরচ হতো দুই হাজার টাকার মতো। দালাল দিয়ে করাচ্ছি বলে ১০ হাজার টাকা লাগছে।’

দিয়াবাড়ী বিআরটিএ কার্যালয়ে টাকা জমা দেওয়ার দীর্ঘ সারি | ছবি- ঢাকা পোস্ট  

তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেকে নিজেই সব কাজ সারছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন, কাগজপত্র ঠিক থাকলে খুব বেশি ঝামেলা হয় না, এক-দুদিন বেশি আসতে হয়।

সেবা নিতে আসা এক নারী নাম প্রকাশ না করে জানান, এখানে ব্যবস্থাপনাটা অনেক এলোমেলো। নিজে নিজে কাজ করতে গেলে কিছুটা হলেও হয়রানির শিকার হতে হয়। সঠিক তথ্য ও দিকনির্দেশনা আপনি পাবেন না। ওই সিস্টেমটা একেবারেই উন্নত হয়নি এখানে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকাশ্যে কাজ করা এসব দালালের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কি কিছুই জানে না? হজরতসহ একাধিক দালালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্তাদের মাধ্যমেই এসব কাজ করে থাকেন তারা। তারাও (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) ভাগ পেয়ে থাকেন।

এদিকে, দালাল ধরে অনেকে আবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এমন প্রমাণও মিলল এখানে। পারভেজ নামের এক ভুক্তভোগী এ প্রতিবেদককে জানান, এক বছর পার হলেও তার লাইসেন্সের কাজ শেষ হয়নি। দালালের পেছনে ঘুরে ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবাই যে ভালো মানুষ তা কিন্তু নয়। তাই দালাল ধরলেও দেখেশুনে ধরতে হবে— এমন পরামর্শ দিয়ে হাঁটা শুরু করেন পারভেজ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কের সার্বিক নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে চালকদের ওপর। তারা যদি সুশৃঙ্খল হন তাহলে সড়কও হয় নিরাপদ। কিন্তু সড়ক ব্যবহারের শুরুতে গাড়ি চালানোর স্বীকৃতিপত্র অর্থাৎ সনদ পেতে যদি এমন হয়রানির শিকার হতে হয় তাহলে সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এক্ষেত্রেও হয়রানিবিহীন একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

একে/এমএআর