দেশের শান্তিশৃঙ্খলার পরিপন্থি এবং জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সাতটি সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ হওয়া এবং বিভিন্ন সময় আলোচনায় আসা এসব জঙ্গি সংগঠনের অনেকগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও আনসার আল ইসলামের মতো কিছু সংগঠন এখনো সক্রিয় রয়েছে।

এরই মধ্যে সম্প্রতি দেশে আরও একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল নামে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের ৩৮ জন সদস্য ইতোমধ্যে বাড়ি ছেড়েছেন বলে দাবি করেছে র‍্যাব। নিখোঁজদের মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

র‍্যাব জানায়, ঘর ছাড়া জঙ্গিরা হিজরতে বের হয়ে ভোলার চরাঞ্চলে ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় রয়েছেন গোয়েন্দারা। এ সংগঠনের সদস্যরা কী কারণে হিজরতে যাচ্ছেন তা এখনও স্পষ্ট নয় গোয়েন্দাদের কাছে। এছাড়া তারা প্রশিক্ষণ কেন নিচ্ছেন বা তাদের নাশকতার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট ধোঁয়াশা।

জঙ্গি দমনে কাজ করে এমন একটি সংস্থার গোয়েন্দারা জানান, নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অধিকাংশ সদস্য কোনো না কোনোভাবে আনসার আল ইসলামসহ পুরোনো কিছু জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বিগত দেড়-দুই বছর ধরে তারা নানাভাবে একত্রিত হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। সর্বশেষ গত এক বছর আগে সংগঠনটির কিছু সদস্য কথিত হিজরতের জন্য ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। এদের মধ্যে কিছু সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার অনেকে নিজে থেকে ঘরে ফিরে এসেছেন বলেও তথ্য রয়েছে। 

আরও পড়ুন : ‌র‌্যাবের তালিকায় উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ ১৯ জেলার ৩৮ তরুণ

তবে তারা ঠিক কী কারণে হিজরতে যাচ্ছেন আবার কেনই বা নিজে থেকে ঘরে ফিরে আসছেন তা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে গোয়েন্দাদের মনে। আসলে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির আদৌ কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি কিংবা উদ্দেশ্যে আছে কি না সে বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন গোয়েন্দারা। বিভিন্ন পুরোনো জঙ্গি সংগঠনের কিছু সদস্য একত্রিত হয়ে নতুন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে গোয়েন্দাদের নজর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন কি না তা নিয়েও তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।

জঙ্গি দমনে কাজ করে এমন একটি সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছর খানেক আগে থেকে তারা টের পাচ্ছিলেন আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য একত্রিত হয়ে নতুন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। বছর খানেকের মধ্যে স্বেচ্ছায় উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ এমন কিছু তরুণও পেয়ে যান তারা। এরপর থেকে বিভিন্ন এনক্রিপটেড অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তবে তারা বছর খানেক আগে থেকেই গোয়েন্দাদের নজরে ছিলেন। তাদের বিভিন্নভাবে নজরদারি করা হচ্ছিল।

উদ্দেশ্য নিয়ে ধোঁয়াশা
গোয়েন্দারা বলছেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আনসার আল ইসলামের সাংঠনিক কার্যক্রমও সক্রিয় রয়েছে। তবে তারা কী উদ্দেশ্যে নতুন প্লাটফর্মে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছেন তা স্পষ্ট নয়। নতুন জঙ্গি সংগঠনের অনেক সদস্য হিজরতে বের হয়ে আবার নিজ থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। এছাড়া জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে অর্থ সংগ্রহ করছেন এমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তাদের এ ধরনের কার্যক্রম গোয়েন্দাদের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে, আসলে তাদের উদ্দেশ্য কী? 

উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৩৮ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র্রাব

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৪ জন সদস্য সিলেটের নিজ বাড়ি থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি ইউনিট সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আসলে অনলাইনে কোনো এক হ্যান্ডেলারের ডাকে তারা বের হয়েছিলেন। কিন্তু বের হয়ে সংগঠনের তেমন কোনো কার্যক্রম দেখেননি তারা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাড়ি ফিরে যাবেন, এর মধ্যেই তারা গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার ৪ যুবক জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় তাদের ‘ডির‌্যাডিকালাইজেশন’ করে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিজে থেকে ফিরে আসার বিষয়টির একাধিক কারণ থাকতে পারে। তারা হয়তো যে আশা বা উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন সেটি পূরণ হয়নি বা সম্ভব নয়, সেজন্য ফিরেছেন নিজে থেকে। নতুবা সাংগঠনিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম না থাকায় তারা হতাশ হয়ে ফিরেছেন। তবে তাদের মধ্যে কিছু লোক এখনও পলাতক রয়েছেন, কয়েকজন হয়তো প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে সংগঠনটির কোনো উদ্দেশ্য পাওয়া যাচ্ছে না, আসলে তারা ঠিক কোথায় কী করতে চাচ্ছে। 

আরও পড়ুন : ‌এটি ভুল পথ, এ পথে যেন কেউ পা না বাড়ায়

এ বিষয়ে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস বিভাগের পুলিশ সুপার মোহম্মদ আসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন যে জঙ্গি সংগঠনটির নাম আসছে এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। তবে সংগঠনটি নিয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। অনেকে ঘর ছেড়েছে বলে তথ্য আসছে, এ বিষয়েও আমরা তথ্য যাচাই-বাছাই করছি।

নতুন সংগঠনের হ্যান্ডেলার কে?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, কারাগারে থাকা জঙ্গি জসিমউদ্দিন রাহমানির একটা আধিপত্য দেখা গেছে নতুন সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে। এছাড়া কুমিল্লার পলাতক জঙ্গি হাবিবুল্লাহও নতুন সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতা বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সংগঠনটি কার নির্দেশনায় তৈরি হয়েছে বা কে কার্যক্রম পরিচালনার করার চেষ্টা করছে তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। 

জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়েছিলেন শারতাজ ইসলাম নিলয়। তবে জঙ্গিবাদ ভুল পথ তা বুঝতে পেরে ফিরে আসেন তিনি।

গোয়েন্দারা বলছেন, কারাগার থেকে নাকি বাইরের কারো নির্দেশে নতুন এই জঙ্গি প্লাটফর্মটি পরিচালিত হচ্ছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য নেই।

এর মধ্যে অবশ্য শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন স্যার ওরফে মেন্ডিং মুরং নামে একজন এ সংগঠনের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন বলে খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। 

বিদেশি মদদও থাকতে পারে 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, নতুনভাবে নাম আসা জঙ্গি সংগঠনটির পেছনে কোনো বিদেশি মদদ থাকতে পারে। তারা কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের পুরোনো ও কিছু নতুন সদস্যদের দিয়ে কিছু একটা করাতে চায় দেশে।  বিদেশি মদদের বিষয়টি এখনও শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া গেলেও এমন কিছু থাকতে পারে ধারণা করে তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।

জঙ্গি দমনে কাজ করেন এমন একটি সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে পুরোনো ও নতুন কিছু জঙ্গি মিলে একত্রিত হয়ে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন। সেই আভাস অনেক আগেই পাওয়া যায়। তারা একটি নতুন প্লাটফর্ম দাঁড় করাতে চায় সেটারও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তবে নতুন যে জঙ্গি সংগঠনের নামটি এলো সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই নাম কারা দিয়েছে বা কেন দিয়েছে কিংবা আসলেই এই নাম কি না তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, যেহেতু নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সদস্য সংগ্রহ করা ছাড়া তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই, তাই তাদের খুব বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে না। আর যা কিছু অর্থ খরচ হচ্ছে তা নিজেরাই আপাতত জোগান দিচ্ছেন। 

আরও পড়ুন : ‌সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে গঠিত হয় নতুন ‘জঙ্গি মঞ্চ’

কথিত হিজরত করে ঘড়ছাড়া কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে

এ বিষয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে অনেকে চাকরিজীবী অথবা অনেকে বাড়ির মালিক। তারা নিজেরাই এখন কিছু টাকা পয়সা সাংগঠনিক কাজের জন্য দিচ্ছে। বিদেশ বা অন্য কোনো সোর্স থেকে অর্থায়নের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে নতুন জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত নতুন জঙ্গি সংগঠনের বাড়ি ছাড়া একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের পার্বত্য অঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে নিখোঁজ জঙ্গিরা বোমা তৈরি ও অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তবে তারা কী পরিকল্পনায় এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বা তাদের কোনো নাশকতার পরিকল্পনা আছে কি না তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই। তবে তাদের গ্রেপ্তারে সমন্বিত অভিযান চলছে।

আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে কারাগারে থাকা জঙ্গিনেতা জসিমউদ্দিনের  অনুসারীরা নতুন জঙ্গি সংগঠন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের পর থেকে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের মধ্যম সারির নেতা হলেন কুমিল্লার মসজিদে কোবার ইমাম শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নেছার উদ্দিন উমায়ের ও পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষক হোসাইন আহম্মদ। তিন জনের মধ্যে নেছার ও হোসাইন র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলেও পলাতক রয়েছেন ইমাম হাবিবুল্লাহ। এছাড়া ধারণা করা হচ্ছে হাবিবুল্লাহর নির্দেশে কুমিল্লা থেকে অনেক তরুণ জঙ্গি সংগঠনটিতে যুক্ত হতে ঘর ছেড়েছিলেন।

এমএসি/এনএফ