পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সংবাদ সম্মেলন/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

রাজশাহীর মঞ্জুর রহমান। প্রথমে ফ্ল্যাট কেনার প্রস্তাবে যান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন মিরপুর মানিকদিতে পূর্ব হাসনা ভিলায়। সেখানে গিয়ে তিনি পান লোভনীয় প্রস্তাব। লগ্নি করলেই ৩০ মাসে দ্বিগুণ টাকা। সে টাকার অর্ধেক প্রতি মাসে পাবেন। লাভের বাকি অংশ ফ্ল্যাটের কিস্তি হিসেবে কেটে নেওয়া হবে। এমন অবিশ্বাস্য প্রস্তাবের বিশ্বাসযোগ্যতার খোঁজ না নিয়ে ১০ লাখ টাকা লগ্নি করেন মঞ্জুর। দুই মাস লাভের টাকা পেলেও তৃতীয় মাসেই লাপাত্তা সেই এসএস আবাসন। লোভে মূলধন হারিয়ে এখন এই ব্যবসায়ীর পথে বসার দশা।

তিনি মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি লাখে ৬ হাজার ৩০০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাবে এসএস আবাসনে ১০ লাখ টাকা লগ্নি করি। প্রতি মাসে ৬৩ হাজার টাকা লাভ পাব। এরমধ্যে তারা ৩১ হাজার ৫শ টাকা তিন মাস দেয়। বাকি টাকা কেটে নেয় ফ্ল্যাট বাবদ। এরপর আর এসএস আবাসনের সন্ধান পাইনি। এখন লাভও নেই, আসলও নেই।

প্রতারণার শেষ কোথায়

মঞ্জুর রহমান বলেন, কয়েকদিন আগে সিআইডির অভিযানে গ্রেফতার হয় প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা। টাকার জন্য মূলহোতা রাশেদুল রহমান একদিন মুঠোফোনে কথা বলেন। রাশেদুল লাভ কেন আসলও ফেরত দেবেন না বলে জানান। পুলিশকে সহযোগিতা করায় এই হুমকি দিয়েছেন তিনি। আমার সারা জীবনের পুঁজি ফাঁদে পড়ে হারালাম।

এমন ছয় শতাধিক ভুক্তভোগীর তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। ২ লাখ থেকে শুরু করে ১৩ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে এসএস আবাসন নামে ওই প্রতিষ্ঠানটি।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি চক্রটির ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয় আরও ৯ প্রতারক

একই প্রক্রিয়ায় ক্যাশ টাকা নিয়ে দুই বছরে দ্বিগুণ লাভের প্রলোভনে ২ হাজার ২শ ৯ জন গ্রাহকের প্রায় ৫৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে ‘সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। গত ৮ ফেব্রুয়ারি চক্রটির ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।

সিআইডি বলছে, প্রত্যেকের প্রতারিত হবার গল্প একই। কিন্তু একেকজনের কষ্টের গল্প একেক রকম। এখনও অনেকে আছেন যারা টাকা ফেরতের আশায় সিআইডিকে তথ্য দিচ্ছেন না। আবার অনেকে সিআইডির কল এড়িয়ে চলছেন।

লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে পড়ে পস্তাচ্ছেন শত শত ব্যক্তি

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকা থেকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার আড়ালে গ্রাহকদের ৩০ মাসে দ্বিগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে ৬ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎকারী চক্রটির ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডি। সিআইডি জানিয়েছে, গ্রেফতারদের মধ্যে ৩ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। প্রতারিত ৬ শতাধিক ভুক্তভোগীর মধ্যে অর্ধেকের বেশিই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য। চক্রটির টার্গেট অবসরপ্রাপ্তরা।

এমনই একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট নাটোরের জাহাঙ্গীর আলম (৪৯)। অংশীদারি ভিত্তিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় দ্বিগুণ লাভের প্রস্তাবে এসএস আবাসনে পেনসনের ৪ লাখ টাকা লগ্নি করেন তিনি। এরপর লাভের ২৫ হাজার ২০০ টাকার একটিও তিনি পাননি। দেখতে পানটি ফ্ল্যাটের ছবিও। শুধুমাত্র এক সহকর্মীর কথায় বিশ্বাস করে লগ্নি করেছিলেন তিনি। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি লাভের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। যদিও আসল ফেরতের আশা ছাড়েননি।

ভেবেছিলাম প্রতিষ্ঠানটিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরাও আছেন, এখানে প্রতারণার সুযোগ নেই

কুষ্টিয়ার আইয়ুব হোসাইন

২০১৪ সালে সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল পদ থেকে অবসরে যান কুষ্টিয়ার আইয়ুব হোসাইন। পেনশনের টাকায় অংশীদারি ভিত্তিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় দ্বিগুণ লাভের প্রস্তাব পান তিনি। লাখে ৬ হাজার ৩০০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাবে এসএস আবাসন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ৪ লাখ টাকা লগ্নি করেন তিনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি লাভের ২৫ হাজার দুইশ টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

তিনি সিআইডি কার্যালয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ভেবেছিলাম প্রতিষ্ঠানটিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরাও আছেন, এখানে প্রতারণার সুযোগ নেই। লাখে ৬ হাজার ৩০০ টাকা পাওয়ার আশায় ৪ লাখ টাকা লগ্নি করেছি। এখন লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাও নেই। আমার তো ভাই সব শেষ।

আর তারা প্রতারিত হতে চান না, ফিরে চান মূলধন

পরে যোগাযোগ করা হলে আইয়ুব আলী বলেন, গণমাধ্যমে কথা বলায় প্রতারক চক্রটির মূলহোতা রাশেদুল নগদ টাকা ফেরত  দেবে না বলে ফোন করে হুমকি দিয়েছে। আমার কারণে নাকি রাশেদুল ফেরারি, পলাতক। তার হুমকি ও মূলধন ফিরিয়ে দেওয়ার প্রলোভনে অনেক ভুক্তভোগী পুলিশকে সহযোগিতা করছেন না। নতুন করে যেন আমরা প্রতারিত না হই। চক্রটির মূলহোতা ধরা পড়লে টাকা ফেরত পাবার সুযোগ তৈরি হবে।

চক্রটির মূলহোতা খুবই ধুরন্ধর। ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পাল্টাচ্ছেন।

সিআইডি ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক

এ ব্যাপারে সিআইডি ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চক্রটির মূলহোতা খুবই ধুরন্ধর। ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পাল্টাচ্ছেন। আমরা তাকে অনুসরণ করছি, গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

প্রচারক চক্রটির কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, গত দেড় বছর ধরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার ও অধিক মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে আসছেন তিনি। ছয় শতাধিক ভুক্তভোগীর ৭ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের তথ্য পেয়েছি। প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা নিয়ে ঠিকানা পরিবর্তন করে আত্মসাৎ করে আসছিলেন তিনি।

ফাঁদে পা দেওয়াদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যের সংখ্যাই বেশি।

ক্যান্টনমেন্টের পাশেই মাটিকাটায় এসএস আবাসনের অফিস। ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহীরা এলে ৩০ মাসে টাকা দ্বিগুণের লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার বিনিয়োগকারী যোগাড় করতে পারলে ৬ শতাংশ কমিশনের প্রলোভন দেখানো হয়। এই ফাঁদে পা দেওয়াদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যের সংখ্যাই বেশি।

সিআইডি ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, এসএস আবাসন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেছে। ডাচ বাংলা, ট্রাস্ট ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক। এ তিন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেনের ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেয়েছি। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসেব ফ্রিজ করতে অনুরোধ করা হবে।

রিয়েল এস্টেট ব্যবসার আড়ালে ছড়ানো প্রতারণা ফাঁদ 

অন্যদিকে সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেডের প্রতারণা সম্পর্কে তিনি বলেন, একই কায়দায় প্রচার-প্রচারণা চালায় সীল সিটি নামক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা। গ্রাহকরা অংশীদার ব্যবসা ও জমি কেনার আগ্রহ নিয়ে তাদের কার্যালয়ে আসেন। তখন চক্রটি মাত্র দুই বছরে টাকা দ্বিগুণের প্রলোভন দেখায়। পাশাপাশি ব্যবসার একটা লভ্যাংশ এবং আরও গ্রাহক এনে দিলে সেটার ওপরে নির্দিষ্ট পরিমাণ পার্সেন্টেজ দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। লাখে প্রতি মাসে আট থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা এবং দুই বছরে দ্বিগুণ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা।

এভাবে তারা ২ হাজার ২শ ৯ জন গ্রাহকের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা জমা নেয়। এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে নামেমাত্র একটি মানি রিসিট দেয় তারা। টাকা নেওয়ার পর অনেক গ্রাহককেই ৩/৪ মাস টাকা দিলেও এরপর বন্ধ করে দেয়। টাকা ফেরত চাইলে তারা ঘুরাতে থাকে।

রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কথা বললেও তাদের কোনো জমিই নেই। নামমাত্র মানি রিসিট ছাড়া কোনো ধরনের ডকুমেন্ট নেই টাকা লেনদেনের।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড নামক ওই প্রতিষ্ঠানটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কথা বললেও তাদের কোনো জমিই নেই, জমি কেন্দ্রিক ব্যবসাও নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নামমাত্র মানি রিসিট ছাড়া কোনো ধরনের ডকুমেন্ট নেই টাকা লেনদেনের। চেকে টাকা লেনদেন না করে সব গ্রাহকের টাকা তারা নিয়েছে নগদে।

ভুক্তভোগী গ্রাহক স্কুলশিক্ষক নাসিম উদ্দিন মাস্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলাম। লাখ প্রতি তারা আট হাজার টাকা দেওয়ার কথা। লভ্যাংশ হিসেবে কয়েক মাসে ৬৯ হাজার টাকা পেয়েছি। আর ২ বছর পর গিয়ে জমি নেব কি-না সেই সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু তারা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে ঘুরেও টাকা পাইনি।

অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান ২৪ বা ৩০ মাসে দ্বিগুণ লভ্যাংশ দেবে তা বিশ্বাসযোগ্য না। এধরনের প্রচার-প্রচারণা বা প্রলোভনে বিশ্বাস করা মানে হচ্ছে প্রতারণার শিকার হওয়া। গ্রাহকদের এক্ষেত্রে উচিত সচেতন হওয়া। পুলিশকে জানানো।

জেইউ/এইচকে