নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার গঠনের পরিকল্পনা হয় কারাগারে। ২০১৭ সাল থেকে এ জঙ্গি সংগঠনটি গঠনের কাজ শুরু করে দেয় এর সঙ্গে জড়িত মাস্টামাইন্ডরা। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণও শুরু হয় সংগঠনটির। সম্প্রতি সংগঠনটির বেশ কয়েক জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এ সংগঠনটির উদ্দেশ্য কী তা এখনো জানা যায়নি।

বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।

আসাদুজ্জামান বলেন, বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সিটি ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন— নাটোরের মো.আব্দুল্লাহ (২২), কুমিল্লার চান্দিনা মো. তাজুল ইসলাম (৩৩), নারায়ণগঞ্জ মো. জিয়াউদ্দিন (৩৭), মাদারিপুর মো. হাবিবুল্লাহ (১৯) ও নারায়ণগঞ্জ মাহামুদুল হাসান (১৮)।  গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৩টি ফোন, ফতোয়া সংক্রান্ত ১২ পাতা কাগজ জব্দ করা হয়েছে।

তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজরতের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল। গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ ‘আনসার হাউজ’ পরিচালনা করতো। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য হিজরতের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেত তাদের এই আনসার হাউজে জায়গা দিত আব্দুল্লাহ। পরে সেই আনসার হাউজ থেকে আব্দুল্লাহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে পাঠাতো।

এছাড়া নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য আনসার হাউজে আসতেন তাদের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে রিসিভ করতেন গ্রেপ্তার তাজুল ও হাবিবুল্লাহ।

তিনি বলেন, গত আগস্ট মাসে কুমিল্লা থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে সাত তরুণ ঘর ছাড়ে হিজরতের উদ্দেশে। এ বিষয়টি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হলে সিটিটিসি তদন্ত শুরু করে। এর আগে আবরার নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবরারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হিজরতের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়েছিল। ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী নামে এক জঙ্গি আবরারকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল। এরপর ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালীকেও আমরা গ্রেপ্তার করি। এই শাকের বিন ওয়ালি হচ্ছে নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান। শাকের বিন ওয়ালী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস শেষ করেছে। তিনি জঙ্গি সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও আরেক হুজুরের নির্দেশে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা কাজ করতো।

এই শাকের বিন ওয়ালি প্রতি মাসে একবার করে বান্দরবান এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। সেখানে তাদের কোনো সদস্য অসুস্থ বা রোগে আক্রান্ত হলে তিনি চিকিৎসা দিতেন। মূলত নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অসুস্থ সদস্যদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্যই প্রতি মাসে তিনি একবার করে প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। আবার তিনি যখন ঢাকায় থাকতেন তখন নতুন জঙ্গি সংগঠনটি প্রধান শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। ফোনে সদস্যদের অসুস্থতার লক্ষণ শুনে ব্যবস্থাপত্র পাঠাতেন শাকের বিন ওয়ালী। এছাড়া জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিনের সদস্যরা আহত হলে সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করতেন ডা. শাকের।

তিনি আরও বলেন, ডা. শাকেরকে জিজ্ঞাসাবাদে মহসিন এলায়েস ওরফে রিয়েল নামে একজনের নাম উঠে আসে। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।

ডা. শাকের দুই দিন আগে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। নতুন সংগঠনটির সৃষ্টির বিষয়ে তিনি জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, নতুন সংগঠনটির প্রথম আমির মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত রক্সি ছিল এই সংগঠনের আমির। ২০২১ সালে রক্সিকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। দুয়েক দিন আগে আমরা রক্সিকে আবার রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। রক্সি আমাদের জানায়, এই সংগঠনের মূল মাস্টার মাইন্ড শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার। ২০১৪ সালে শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এর আগে রক্সিও ২০১৫ সালে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। রক্সি ও শামিন যখন এক সঙ্গে জেলখানায় ছিল তখন তারা সেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসে। আবু সাইদের সংস্পর্শে এসে তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। এই তিন জন জেলখানায় বসে নতুন সংগঠনটি তৈরি করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা হয় রক্সি ও শামিন জেলখানা থেকে বের হয়ে জঙ্গিদের নিয়ে শক্তিশালী একটি সংগঠন গঠন করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জামিনে বের হয়ে রক্সি ও শামিন কাজ শুরু করে।

এই ধারাবাহিকতায় তারা সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ি এলাকায় একটি ক্যাম্পের সন্ধান শুরু করে।

ডা. শাকের, কৃষিবিদ মহসিন ও রক্সির তথ্যে বরাত দিয়ে সিটিটিসি প্রধান আরও বলেন, শামিন মাহফুজ ২০০৬ সাল থেকে পাহাড়ি এলাকায় একটি জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করে আসছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালে যখন সে জামিনে বের হয়ে আসে তখন পাহাড়ি এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুঁজতে থাকে। সে জানতে পারে পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন নামে একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠনটির প্রধান হলেন নাথান বম। এই নাথান বম হচ্ছে শামিন মাহফুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্টতম বন্ধু। শামিন মাহফুজ ও নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এছাড়া শামিন একটি ক্যাডেট কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সে মেধাবী তালিকায় স্থান করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পাস করে। সেই নাথান বমের সঙ্গে যোগাযোগ করে শামিন তাকে তার সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। নাথান বম শামিনকে জানায় তারা অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবে। এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতরা ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে মিলিত হয়। ওই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন শামিন, রক্সি, মসীন, বিকাশ ও তমাল নামে আরেকজন। কুকি-চিনের পক্ষ থেকে মিটিংয়ে ছিলেন নাথান বম ও তার দুই সহযোগী। মিটিংয়ে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হলে সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবিরে কাটআউট পদ্ধতিতে যাওয়া শুরু করে। এছাড়া ডা. শাকের বিভিন্ন সময় এ প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করেন।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে যতটুক জানতে পেরেছি সদস্যদের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার কথা চিন্তা করে তারা পার্বত্যাঞ্চলকে প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাদের উদ্দেশ্য যেটা বুঝা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সমতল ভূমিতে এসে হামলা করে আবার যেন নিরাপদে পার্বত্যাঞ্চলের ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারে।

তিনি বলেন, তবে সংগঠনটির অর্থের অনুদান কোথায় থেকে আসে এবং তাদের এই নেটওয়ার্কের বাইরে অন্য কোনো নেটওয়ার্ক আছে কী-না বা তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কী ছিল তা আমরা সংগঠনটির মাস্টারমাইন্ড শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার করতে পারলে জানতে পারব। তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশব্যাপী জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল তা আমরা কিছুটা হলেও ধ্বংস করতে পেরেছি।

এই সংগঠনের কতজন সদস্য হিজরতের নামে নিখোঁজ রয়েছে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমাদের কাছে থাকা তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ৭০ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। হয়তো সবাই প্রশিক্ষণে যায়নি। আমরা যতটুকু জানি তিন ধাপে প্রশিক্ষণ শিবির লোক পাঠানো হয়েছে। তবে সবাই সেখানে যায়নি, অনেকে কোনো শেল্টার হোমে থাকতে পারে। অথবা আগের হিজরত অনুযায়ী ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদ স্থানে আছে।

সংগঠনটির উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগঠনটির প্রধান শামিন মাহফুজ গ্রেপ্তার করলে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। তবে তারা দেশে ভেতরে নাশকতা তৈরি একটা উদ্দেশ্য ছিল। এর বাইরে কোনো উদ্দেশ্য ছিল কী না তা শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার করতে পারলে জানা যাবে।

নির্বাচন কেন্দ্রিক নতুন জঙ্গি সংগঠনের কোনো পরিকল্পনা ছিল কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয়তো তাদের এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে। তবে সংগঠনের প্রধানকে গ্রেপ্তার করা গেলে বিস্তারিত জানা যাবে, তাদের নির্বাচন কেন্দ্রিক কোনো পরিকল্পনা আছে কী না বা তারা কোনো প্রেসক্রিপশন নিয়ে মাঠে নেমেছে কী না অথবা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে মাঠে নেমেছে কি-না।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শামিন মাহফুজ কলেজ পড়ার সময় সে শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে তাকে শিবির করার অভিযোগে ক্যাডেট কলেজ থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে নিকট আত্মীয়র সংস্পর্শে জঙ্গিবাদে জড়ায়। এছাড়া তার স্ত্রীও জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত।

এমএসি/এসএম