বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী ঘন ঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানলের ঘটনা ঘটছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে উন্নত দেশের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের অর্থ সরবরাহে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। 

মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানে উন্নত দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে;  যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। গত দুই বছরে মাত্র ৮৩.৩ বিলিয়ন প্রদান করেছে উন্নত দেশগুলো; যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল।

তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর বাধার কারণে ২০২১ সালের জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা তহবিল গঠন করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে খাদ্য-নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রমে তারা সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় প্যারিস চুক্তির আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, প্রশমন ও অর্থায়নকে গুরুত্ব প্রদান করে আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তাদেরই স্বার্থে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। 

টিআইবি নির্বাহী বলেন,প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু অর্থায়নের সর্বসম্মত সংজ্ঞা না থাকায় ‘নতুন’ ও ‘অতিরিক্ত’ সহায়তাকে ঋণ হিসেবেও প্রদান করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রদত্ত মোট বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের ৭০ শতাংশই ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। জিসিএফ তহবিল প্রাপ্তিতে কঠিন মানদণ্ড নির্ধারণ করায় প্রয়োজনীয় জলবায়ু তহবিল পাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে তাপমাত্রা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির ফলে ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুত প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার এখন আর পর্যাপ্ত নয়, কেননা ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু তহবিলের চাহিদা প্রতিবছর ১৪০-৩০০ বিলিয়ন ডলার হবে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ক্রমবর্ধমান অভিযোজন ও প্রশমন চাহিদা মেটানোর জন্য অর্থায়নের নতুন সম্মিলিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণও জরুরি।

টিআইবি বলছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী ঘন ঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানলের ঘটনা প্রকটতর হয়েছে। অথচ কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে কয়লার ব্যবহার ও রপ্তানি বেড়েছে এবং কয়লাভিত্তিক জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়নও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ রকম একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে মিশরের শার্ম আল শেখে আগামী ৬ থেকে ১৮ নভেম্বর ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের ২৭তম সভা বা কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ২৭) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।  এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর উচিত হবে উন্নত দেশের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণবাবদ প্রদেয় অর্থ সময়াবদ্ধভাবে সরবরাহে একটি রোডম্যাপ ঘোষণায় উন্নত দেশগুলোকে রাজি করানো।

আসন্ন কপ২৭ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতিসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য টিআইবি ‘বাংলাদেশ কর্তৃক কপ২৭ সম্মেলনে উত্থাপনযোগ্য’ ও ‘বাংলাদেশ সরকারের করণীয়’ দুইভাগে মোট ১৬টি দাবি পেশ করছে।

দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে 
• স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে উন্নত দেশগুলোকে ২০২০-২০২৫ মেয়াদের প্রতিশ্রুত মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রস্তুতে সমন্বিত দাবি উত্থাপন। 
• জিসিএফসহ জলবায়ু তহবিলে ঋণ নয়, অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করতে হবে। 
• ক্ষয়-ক্ষতিবিষয়ক আলাদা তহবিল গঠন করতে হবে এবং ঝুঁকি বিনিময়ে বিমার পরিবর্তে অনুদানভিত্তিক অর্থ প্রদান করতে হবে। 

বাংলাদেশ সরকারের করণীয় 
• ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসূত অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে হবে 
• জীবন-জীবিকা, বন ও পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে স্থগিত করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ কৌশলগত পরিবেশের প্রভাব নিরূপণ সাপেক্ষে অগ্রসর হতে হবে। 
• একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপসহ প্রস্তাবিত ইন্ট্রিগ্রেটেড অ্যানার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান-আইইপিএমপিতে কৌশলগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
• বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধিতে এ খাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
• জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সংক্রান্ত সকল প্রকল্পে সুশাসন, শুদ্ধাচার ও বিশেষ করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।  

আরএম/এনএফ