সমীরণ দত্তের শিল্প/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

গল্পের শুরুটা ১৯৯৯ সালে। দৃশ্যপট চট্টগ্রাম শহরের একটি পুকুর পাড়ে পড়ে থাকা গাছের শিকড়কে কেন্দ্র করে। গল্পটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে হিসাবরক্ষকের চাকরি ছাড়া সমীরণ দত্তের, যিনি চাইলেই অনায়াসে সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় অংকের বেতনে চাকরিতে মনোনিবেশ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন ভাস্কর হিসেবে। 

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ঘুঘুশাল গ্রাম। উপজেলার প্রধান সড়কের পাশেই এ গ্রামের অবস্থান। গ্রামের শুরুর দিকেই চারদিকে সবুজ গাছপালা আর লতায়পাতায় ঘেরা ‘মনবাগানে’ পাওয়া যায় সমীরণ দত্তের শিল্প সত্তাকে। এখানেই ৪৭ শতাংশ জায়গার ওপর স্থাপিত ‘প্রিয়ভাষিণী আর্ট গ্যালারি মনবাগান আর্ট পার্ক’। অবশ্য এটি মনবাগান নামেই বেশি পরিচিত।

সমীরণ দত্তের শিল্প/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের শেকড়-বাকড়, কাঠের টুকরো ও গাছের গুঁড়ি দিয়ে সৃষ্টি করে এখানে সাজানো রয়েছে নানা ধরনের শৈল্পিক আসবাবপত্র। গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিচ্ছবি; বিশেষ করে ঘোড়া, প্রজাপতি, গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ব্যতিক্রমী খাট, সোফা, পোডিয়াম, শোপিজ স্ট্যান্ড, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টি-টেবিলসহ অসংখ্য আসবাবপত্র রয়েছে মনবাগানে।

সমীরণের মনবাগান/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

পরিত্যক্ত গাছের শিকড়-বাকড় কিভাবে শিল্পীর জাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় মনবাগানে শিল্পরূপ পেয়েছে তা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। এসব শিল্পকর্ম দেখতে আসা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টিকেট মূল্য ২৫ টাকা করে রাখেন শিল্পী সমীরণ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমীরণের এসব শিল্পকর্ম দেখতে আসাদের মধ্যে সৌখিন এবং শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি।

মনবাগানে কথা হয় ভাস্কর সমীরণের সঙ্গে। শিল্পকর্মে আসা, পাওয়া না-পাওয়া ও জীবনের গল্পসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন। শিল্পী সমীরণ জানান, ২০১৮ সালে ভাড়া করা ৪৭ শতাংশ জমিতেই মনবাগানের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এখানে তার শৈল্পিক হাতে তৈরি ২০০টির বেশি শিল্পকর্ম রয়েছে। 

শিকড়কে শিল্পরূপ দেন সমীরণ/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

সমীরণের ভাষ্যমতে, ১৯৯৯ সালে এক বন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন এলাকার রৌফাবাদে ঘুরতে যান। সেখানে একটি পুকুর পাড়ে পড়ে থাকা একটি গাছের শিকড় তার নজরে আসে। শিকড়টি তুলে এনে ছালবাকল উঠিয়ে একটা অবয়ব দিয়ে বিস্মিত হন তিনি। সেই থেকে শুরু। আর সেই শুরুটাই দীর্ঘ ২২ বছরে সমীরণের শিল্পসত্ত্বাকে দিনে দিনে আরও গভীরে নিয়ে গেছে।

মূলত এসব শিল্পকর্ম তৈরি করতে শুরুর দিকে দূরদূরান্তে ছুটে শিকড় সংগ্রহ করতেন। তবে এখন গাছের শিকড়-বাকড় ও গুঁড়ির সন্ধান পান বন্ধুদের কাছ থেকে। খবর পেলেই ছুটে যান এসব সংগ্রহে। এক্ষেত্রে লিচু গাছের শিকড়ই সমীরণের বেশি পছন্দ। শিল্পকর্ম একা সামাল দিতে না পারায় অজয় সূত্রধর নামক একজনের সাহায্য নেন তিনি।

সমীরণ দত্তের শিল্প/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

চার সন্তানের জনক সমীরণের বেশিরভাগ সময়ই কাটে মনবাগানে। প্রতিদিনই মরা ডাল, গাছের শিকড়-বাকড়, গুঁড়ি এবং কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করেন নতুন নতুন অবয়ব। বর্তমানে লিচুর শিকড় দিয়ে তৈরি করা একটি প্রজাপতিতেই বেশি মনোনিবেশ করছেন তিনি। ছয়মাস ধরে এ প্রজাপতি তৈরি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় বড় বোন মারা যাওয়ায় কাজে মন দিতে পারছেন না সমীরণ।

সমীরণ দত্তের শিল্পকর্ম/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

সমীরণ জানান, ২২ বছর আগে শুরু করা এই শিল্পকর্মের জন্য জন্মস্থান কুমিল্লা থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। ২০০৪ সালের দিকে ঢাকার অদূরে গাজীপুরের পোড়াবাড়িতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু বড় জায়গার অভাবে সেখানে বেশিদিন ঠাঁই হয়নি তার। তারপর সেখান থেকে চলে যান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। আর্থিক অনটনে সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেন নিজ গ্রামেই।

ঢাকা পোস্টকে সমীরণ বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬-৮৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯৩ সালে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে হিসাবরক্ষকের চাকরি নিয়েছিলাম, বেশিদিন থাকা হয়নি সেখানে। অনেক কিছুই করেছি কিন্তু কিছুই আমাকে টানতে পারছিল না। এখন শিল্প নিয়েই আছি। অন্যরা চাকরি নিয়ে বিয়ে করে, আর আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করি। এক মেয়ের জনক হওয়ার পর পথে নামলাম। কেন নামলাম, জানি না। কোথায় শেষ হবে তাও জানি না। 

সমীরণ দত্তের শিল্প/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

২০০৬ সালে ঢাকার গ্যালারিতে সমীরণের প্রথম প্রদর্শনী হয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিনবার একক প্রদর্শনী হয়েছে তার শিল্পকর্মের। এখন পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ১০টির মতো প্রদর্শনী হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কাঠের শিল্পকর্ম ও আসবাব তৈরি করেছেন। এরমধ্যে কিছু বিক্রি করেছেন, কিছু উপহার দিয়েছেন।

শিল্পকর্ম বাঁচাতে তিনবার বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে সমীরণকে। এখন তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন অনুভব করছেন। তবে সত্যিকারের একজন শিল্পী হওয়ায় কারও কাছে গিয়ে ধরনা দেবেন সেটিও পারছেন না।

সমীরণ দত্তের শিল্প/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে ভাস্কর সমীরণ কিছুটা সময় চুপ করে থাকেন। এরপর দার্শনিক কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভালোই আছি। আর কোনো পেশা বা নেশা বেছে নিতে পারব বলে মনে হয় না। আর আমি কখনও পরিকল্পনা করে কাজ করতে পারি না। সে যোগ্যতাই আমার নেই। আমার যেটা মনে চায় সেটাই করব। সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে আসি। বাড়ি থেকে খাবার পাঠানো হয়। এখানে সময় কাটাতে পারলেই ভালো লাগে। 

এনআই/আরএইচ