পুশ বাটন সিগন্যাল

সময়টা ছিল ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর। রাজধানীতে পথচারীদের নিরাপদে সড়ক পারাপার নিশ্চিত করতে নগরবাসীকে নতুন এক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। যার নাম ‘পুশ বাটন সিগন্যাল’। শহরের মোহাম্মদপুর এলাকার গ্রিনহেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে প্রথম বসানো হয় এ ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যাল।

নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সড়ক পারাপারে ইচ্ছুক কোনো পথচারী বাটনে চাপ দিলে ডিজিটাল সিগন্যালে একটি কাউন্টডাউন শুরু হয়। নির্ধারিত সময় শেষ হলে পথচারীদের জন্য সিগন্যালে ভেসে ওঠে সবুজ সংকেত। লাল সংকেত জ্বলে ওঠে যানবাহন চালকদের জন্য। অন্ধ পথচারীদের জন্যও এ ডিভাইসে আছে কণ্ঠ নির্দেশিকা সুবিধা। পথচারী পারাপারের এ বিষয়টিতে খুবই আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও এর সুফল পায়নি নগরবাসী। মোহাম্মদপুরে প্রথম এ ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যাল বসাতে ডিএনসিসির খরচ হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা। একইভাবে মহাখালীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছয় লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয়ে এবং পরে মিরপুর কমার্স কলেজের সামনে সাত লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে এসব পুশ বাটন সিগন্যাল বসায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

উন্নত দেশগুলোর আদলে রাজধানী ঢাকায় এসব ‘পুশ বাটন সিগন্যাল’ বসানো হলেও, শুরুর কিছুদিন পর থেকেই সেগুলো এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কাজে আসছে না। যার কারণ হিসেবে বলা যায়, পথচারীরা এসব ব্যবহারে অভ্যস্ত না, এগুলো ব্যবহারে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নেই কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা। এছাড়া কিছুদিন পর থেকেই এসব সিগন্যালে দেখা দেয় কারিগরি বিভিন্ন ত্রুটি। সব মিলেয়ে কোনোভাবেই প্রযুক্তিটির সঙ্গে পথচারীদের সম্পৃক্ত করতে পারেনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জনপ্রিয়তা না পাওয়া এ সিগন্যালগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে নতুনভাবে কাজ করবে ডিএনসিসি। এছাড়া, নতুন করে নগরের আরও ২০টি স্থানে এ পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি। যেখানে ব্যয় হবে প্রায় দুই কোটি পাঁচ লাখ টাকা।

এ সিগন্যাল বাটনে পথচারীদের পারাপারের জন্য অর্থাৎ সবুজ সংকেত হিসেবে ২৫ সেকেন্ড সময় দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যেই পথচারীদের রাস্তা পার হতে হবে। ২৫ সেকেন্ড পর গাড়ি চলাচল শুরু হবে। এরপর আবার গাড়ি চলাচলের জন্য সময় থাকবে ১২৭ সেকেন্ড। ওই সময়ে বাটনে চাপ দিলেও পথচারী পারাপারের জন্য সবুজ সংকেত দেওয়া হবে না।

কিন্তু বর্তমানে প্রায় সবকটিতেই দেখা দিয়েছে কারিগরি ত্রুটি। সেই সঙ্গে রাস্তা পারাপারে এ সিগন্যাল বাটন ব্যবহারে সাধারণ মানুষের আগ্রহও নেই। পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে মানুষকে এ সিগন্যালের সঙ্গে পরিচয় করাতে পারেনি।

মোহাম্মদপুরে পুশ বাটন সিগন্যালের সামনে কথা হয় হাবিবুর রহমান নামে এক পথচারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, এ সিগন্যালের সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষই পরিচিত না। দুই একজন আগ্রহ নিয়ে সিগন্যালটি ব্যবহার করে রাস্তা পারাপার হতে চাইলেও, অনেক সময় কারিগরি ত্রুটি দেখা যায়। গাড়িচালকরাও এ সিগন্যাল মানেন না। এসব স্থানে সিটি করপোরেশনের লোকজন থাকা উচিত। কিন্তু কেউই নেই। তাই সাধারণ মানুষ সিগন্যালটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়নি।

প্রাইভেটকার চালক সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, এখানে যে এমন একটা সিগন্যাল আছে সেটাই জানতাম না। এর ব্যবহার বাড়াতে অনেক বেশি প্রচারণা দরকার ছিল। সেই সঙ্গে পথচারী ও গাড়িচালকদের সিগন্যাল মানা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি এখানে দরকার ছিল। মানুষকে সিগন্যালের ব্যবহার বিধি জানানোর পরই কেবল সুফল পাওয়া যাবে।

পুশ বাটন সিগন্যালগুলোর সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভুলগুলো ঠিক করে আমরা সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করব।

বর্তমানের পুশ বাটন সিগন্যালগুলো সুফল দিচ্ছে না, এরপরেও নতুন করে কেন আরও ২০টি পুশ বাটন সিগন্যাল বসানো হচ্ছে? ডিএনসিসির পক্ষ থেকে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো কি না? এমন প্রশ্নের লিখিত উত্তরে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বর্তমানে যে তিনটি পুশ বাটন সিগন্যাল আছে, সেগুলো ডিএনসিসির পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। সাধারণ পথচারীদের সচেতন হতে হবে। সাধারণ পথচারীদের রাস্তা পারাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মিডিয়া এ বিষয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

নতুন পুশ বাটনের বিষয়ে করপোরেশন থেকে আরও বলা হয়, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের কারণে কাজটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে পুশ বাটন সিগন্যালগুলোর স্থান নির্ধারণ করে কাজ বাস্তবায়ন চলমান আছে।

তবে পুশ বাটন সিগন্যালে কেনো সুফল পাওয়া গেল না, এ বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের দীর্ঘ আলাপ হয় পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহম্মদ খানের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

অধ্যাপক ড. আদিল মুহম্মদ খান বলেন, যে তিন এলাকায় পুশ বাটন সিগন্যাল বসানো হয়েছিল, সেগুলোতে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি গাফিলতি ছিল। পুশ বাটনগুলো অনেক সময় ঠিকমতো কাজও করছিল না।

নজরদারি থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আসলে আমাদের আগে জানা দরকার ছিল কোথায় পুশ বাটন কাজ করবে, আর কোথায় করবে না। তার কিছু কার্যকরী পরিকল্পনা আগেই করা দরকার ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে নেইবারহুড রাস্তায় পুশ বাটন থাকে। ঢাকার মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে কিছু কিছু প্রাইমারি রোডে কখনই পুশ বাটন কাজ করবে না।

আদিল মুহম্মদ খান বলেন, তাহলে কমিউনিটির ভেতরের রাস্তায় পুশ বাটন দেব কি না, এমন প্রশ্ন এসে যায়। একটা দুইটা পুশ বাটন মানুষের সংস্কৃতি বা আচরণ পরিবর্তন করতে পারে না। পুরো শহরে যদি এটা করা যায়, তাহলে ভিন্ন কথা। অথবা একটি পুরো এলাকাতেই এ পুশ বাটন সিগন্যাল বসাতে হবে। নাগরিক আচার-আচরণ দুই এক জায়গায় পুশ বাটন বসিয়ে বদলানো যাবে না। মানুষ তখন এটা ব্যবহার করবে না। এমন বিচ্ছিন্নতার কারণেই প্রযুক্তিটির সুফল পাওয়া যায়নি।

এক উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ধরে নিলাম একটা শহরে ১০০টি সিগন্যাল বাতির মধ্যে ১০টিতে আছে, বাকি ৯০টি হাতের ইশারায় চলে। সেক্ষেত্রে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। পুশ বাটনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তারা টেকনিক্যালি মনিটরিং করতে পারেননি। তাদের ম্যানেজমেন্ট দুর্বল ছিল। কারণ এটাতে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত না।

তিনি আরও বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে দুই একটি জায়গায় না বসিয়ে যদি এলাকাভিত্তিক বসানো হতো, তাহলেও মানুষ অভ্যস্ত হতো বা এ প্রযুক্তিটি কাজে আসতো। কিন্তু ডিএনসিসি এটা না করে, বিচ্ছিন্নভাবে শহরের তিন প্রান্তে তিনটি এ পুশ বাটন বসিয়েছে। তাই এটি কোনো কাজে আসেনি। সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে আদিল মুহম্মদ খান বলেন, এখন তাদের পুরোনো এ ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে।

এএসএস/এমএইচএস/এসএম/এমএমজে