প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসার পরিচয়ে বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ চক্রের মূলহোতা হরিদাস চন্দ্রকে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সহযোগিতায় গতকাল রাতে রাজধানীর বনানী থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩ এর একটি দল।

র‌্যাব জানায়, হরিদাস প্রতারণার মাধ্যমে মাত্র ৮ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ২০১০ সালেও রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি মেকানিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস ওরফে তাওহীদ (৩৪)। ২০১৮ সালে সবজি বিক্রেতা ছিলেন। ২০১৯ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে হরিদাস চন্দ্র থেকে তাওহীদ ইসলাম নাম ধারণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার প্রতারণা। 

মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

আরও পড়ুন : ঘুষ নিলেন, ভুক্তভোগীকে মামলায়ও ফাঁসালেন তিনি!

তিনি বলেন, এক শ্রেণির প্রতারক চক্র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে বা তাদের প্রটোকল অফিসার বা বিভিন্ন মন্ত্রীর ভুয়া এপিএস পদবি ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে এবং অর্থ আত্মসাৎ করছে। এমনকি প্রতারক চক্র প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসার পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতারক চক্রের প্রতারণাসহ নানা অপকর্মের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে এনএসআই ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে শ্রী হরিদাস চন্দ্র ওরফে তাওহীদ (৩৪) ও সহযোগী ইমরান মেহেদী হাসানকে (৩৮) গ্রেপ্তার করা হয়।

আরও পড়ুন : প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ জয়-লেখক!

হরিদাস বগুড়া শিবগঞ্জের উথলী বাজারের শ্রী গোপীনাথের ছেলে। তার সহযোগী ইমরান মেহেদী হাসান ময়মনসিংহের ত্রিশালের নওদারের সাইফুল ইসলামের ছেলে। 

খন্দকার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হরিদাস ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে অবৈধ উপায়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আত্মীয়ের বাসায় যান। সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে এতিম সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন ও ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে দুই বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে দেশে ফিরে রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি মেকানিকের কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে সবজি বিক্রেতার সঙ্গে সাবলেট বাসা ভাড়া নেন। সেখানেই বিয়ে ও ২০১৯ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে তাওহীদ ইসলাম ধারণ করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে হরিদাস জানান, তার শ্বশুরের পরিচয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় কিছু জমি ক্রয় করেন। তার শ্বশুরের মাধ্যমে এলাকার লোকের সঙ্গে নিজেকে একজন বিত্তশালী লোক হিসেবে পরিচিত হন। পাশাপাশি প্রচার করতে থাকেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে এবং পোশাক পরিধান করে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, গণ্যমান্য বিত্তশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে তোলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টে বিনিয়োগে প্রলোভন দেখান। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অর্থ এবং উন্নয়নমূলক কাজের সম্পন্ন করতে তাদের আশ্বস্ত করতেন। তার প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই চাকরি, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদবির নিয়ে তার কাছে আসা শুরু করেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সে চাকরি প্রত্যাশী, পছন্দমতো জায়গায় বদলি, সরকারি চাকরী, বিভিন্ন ক্রয় বিক্রয় ও উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ শুরু করে।

গ্রেপ্তার ইমরান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত তার বিভিন্ন সহযোগীসহ অন্যান্য ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে হরিদাসের কাছে নিয়ে আসতেন। এ সময় হরিদাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে চাকরি, পদোন্নতি এবং বদলির বিষয়ে আশ্বস্ত করে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করেন।

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হরিদাস অত্যন্ত বচনপটু। একবার তার সঙ্গে কেউ পরিচিত হলে তার প্রতারণার খপ্পর থেকে বের হতে পারে না। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ২০১৯ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমি ক্রয় করে প্যারিস সুইমিংপুল এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক নামে রিসোর্টের কাজ শুরু করেন। সেখানে তার প্রলোভনে পড়ে অনেকেই টাকা লেনদেনের রসিদ ছাড়া লাখ লাখ টাকা লগ্নি করেন। ২০২০ সাল প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্টের কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। রিসোর্টে প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা, সুইমিংপুলে গোসল ১০০ টাকা এবং রিসোর্টের ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য ৫০ টাকা করে টিকিট বিক্রি করা শুরু করেন। অনেকে বিবাহ, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তার রিসোর্ট ভাড়া নিতে থাকে। হরিদাস বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যক্তিদের তার রিসোর্টে আমন্ত্রণ জানান এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার এডিট করা ছবি প্রদর্শন করে তার প্রজেক্টসহ অন্যান্য প্রজেক্টে বিনিয়োগ করার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেন।

প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, তার মোবাইলে বিভিন্ন নম্বর প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এবং নিকটাত্মীয়ের বিভিন্ন সদস্যদের নামে সেভ করে ও কল দিয়ে দেখাতেন। নিজেকে প্রভাবশালী বলে জাহির করতেন। যদিও প্রকৃতপক্ষে তার কোন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সঙ্গে পরিচয় নেই। তার কোন দলীয় পরিচয় নেই। প্রতারণা করে অর্থ উপার্জনই তার মূল লক্ষ এবং পেশা।

ছবি এডিট করে প্রতারণা করতেন তিনি

একাধিক ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট রয়েছে উল্লেখ করে কমান্ডার মঈন বলেন, একাউন্টগুলোতে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি ফুলবাড়িয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে শতাধিক লোকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার কাজে বাধা দেওয়ায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। স্বর্ণ চোরাচালান ও স্বর্ণের বারের অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গেও তিনি জড়িত বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।

গ্রেপ্তার ইমরান মেহেদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার। তার নামে প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি প্রদান, অনলাইনে নিবন্ধন আবেদন, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নবায়নসহ অর্থ জালিয়াতির বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় শাস্তিস্বরূপ ২০২২ সালে বিভাগীয় শহর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়।  

ইমরান হরিদাসের মাধ্যমে নিজের বদলি বাতিল করার চেষ্টা করেন। দুজনে মিলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন সদস্যের নাম লিখে ভুয়া সিল দিয়ে একটি ভুয়া ডিও লেটার তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মোবাইলে অ্যাপসের মাধ্যমে প্রেরণ করে দ্রুত বদলির আদেশ বাতিল করে পূর্বের পদে বহালের জন্য সুপারিশ করেন। তবে ডিও লেটারটি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এনএসআইয়ের কাছে অভিযোগ করলে চক্রের প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে।

জেইউ/এসকেডি