নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল আছে। বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে আসছে। আমাদের ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগ করছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। 

তিনি বলেন, অপেশাদারিত্ব নিয়ে ব্যবসা করলে হবে না। ব্যবসায়ীদের দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করতে হবে। 

দৈনিক ইত্তেফাকের আয়োজনে রোববার (২০ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘বাংলাদেশের শিপিং খাত: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।

নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের ৬১টি পতাকাবাহী জাহাজ ছিল, এখন সেটির সংখ্যা ৯০টি ছাড়িয়ে গেছে। একসময় আমরা শুনেছি কাজ হবে, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি কাজ হচ্ছে। মাতারবাড়ি সাগর ছিল, সেই সাগরকে অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়েছে। 

মাঠ প্রশাসনের কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সচিবরা এখন মাঠপর্যায়ে ভিজিট করে। আগে বিভাগীয় কমিশনারদেরও পাওয়া যেতো না। সরকারের মূল কাজ সংকট সমাধান করে পথ দেখানো। সেই কাজটিই আমরা করছি।

আলোচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, শিপিংবান্ধব স্থানে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরকে এখনই ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে হাব পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমান সক্ষমতায় আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট সেবা প্রদানে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু শিপিং সেক্টরের দ্রুত বিকাশের অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত কয়েকটি খাতকে গঠনমূলক কর্মপন্থার মাধ্যমে সংস্কার করা গেলে বাংলাদেশ শিপিং খাত বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক এগিয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান ইকবাল আলী শিমুল বাহ্যিক রেমিট্যান্স, বিএসএএ কমিশন পুনর্নির্ধারণ, বিল অফ লেডিং, মিস ডিকরেশন, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট লাইসেন্সিং ইস্যু এবং বন্দর পরিচালনা সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে প্রধান ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। মেইন লাইন অপারেটরদের নির্দিষ্ট হারে অর্থ পাঠাতে হয়। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বেশ কিছুদিন এই রেমিট্যান্স পাঠানো যাচ্ছে না।  

ইকবাল আলী শিমুল আরও বলেন, বিভিন্ন শিপিং লাইনের ১৫ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স মুলতবি থাকায় দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এ অর্থ পাঠাতে না পারলে সাপ্লাই চেইন প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়বে, সামগ্রিক অর্থনীতি মন্দার শিকার হবে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, শিপিং ব্যবসা যারা করতে চাচ্ছে তারা বিগত দুই বছর কোনো লাইসেন্স পাচ্ছে না। শিপিং লাইসেন্সের যিনি মালিক তিনি মারা গেলে তার উত্তরাধিকার যারা তাদেরকেও সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে। তার মানে কোনো কারণে আমার ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে দীর্ঘদিনের শিপিং ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়াডার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কবির আহমেদ বলেন, শিপিং খাত অর্থনীতির লাইফলাইন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই আমাদের সাড়া দেয় না। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর কথা উল্লেখ করে বলেন, লাইসেন্সের বিষয়টি বড় সমস্যা। কথায় কথায় উনারা লাইসেন্স নিয়ে টানাটানি করেন।

বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রেমিট্যান্স আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ২২ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন/কর দিতে হচ্ছে। এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা প্রয়োজন। এতো বেশি কর দিতে হলে অনেকেই অবৈধ পথে অর্থ পাঠাতে বাধ্য হতে পারে। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চাই। এজন্য আমাদের কন্টেইনার টার্মিনালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বে টার্মিনাল চালু করতে হবে। কাস্টমসের কারণে ব্যবসায়ীদের হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। কাস্টমসের জটিলতার কারণে অনেক পণ্য ২০১৩ সাল থেকে বন্দরে পড়ে আছে। এসব জটিলতা নিরসন জরুরি।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, শিপিং এজেন্টদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে দেশীয় ব্যবস্থা মিলিয়ে না চললে আমরা এগোতে পারব না। 

তিনি বলেন, শিপিং খাতের লাইসেন্স একটি বড় সমস্যা। এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর অসততার জন্য প্রায়ই দেশের সব ব্যবসায়ীকে দোষারোপ করা হয়। এটা ঠিক নয়। শিপিং খাতের সমস্যা দূর করতে সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তরিক হতে হবে। ১০০-১৫০ বছরের আইনে চলছে শিপিং খাত। এসব সংস্কার করতে হবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বা এনবিআর কথা শুনতে চায় না। গুজব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার দিলো। এতে করে আরও আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। ব্যাংক ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল। এগুলো কিন্তু পাচারকৃত সোনা। এই বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত ছিল।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নূরুল কাইয়ুম খান বলেন, রিজার্ভের ব্যাপারে যতটা না সমস্যা আমরা তার চেয়ে বেশি হুলুস্থল করছি। সমস্যাটা যাদের মুখ দিয়ে বের হওয়ার কথা তা তারা ঠিকভাবে বলতে পারছি না। সবকিছু নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন হচ্ছে। 

এমসিএল সার্ভিসের প্রেসিডেন্ট বরন্ড সিনিয়র পার্টনার মহিউদ্দিন আব্দুল কাদির বলেন, রেমিট্যান্স ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর। যেভাবে রেমিট্যান্স আটকে দেওয়া হচ্ছে তা ভুলনীতি প্রসূত। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। 

তিনি শিপিং এজেন্টের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য স্বাধীন কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি বলে উল্লেখ করেন।

গ্লোবাল টিভির সিইও এবং এডিটর ইন চীফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা বিশেষ করে রিজার্ভের বিষয়টি ফুটপথ পর্যন্ত চলে গেছে। অর্থনীতি নিয়ে নেগেটিভ প্রচারণা হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। 

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম হবে আঞ্চলিক হাব-এটি অনেক আগে থেকে শুনেছি, কিন্তু এখনো হয়নি সেটা।

একাত্তর টিভির হেড অব বিজনেস নিউজের কাজী আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ থেকে এয়ারশিপমেন্টের মাধ্যমে ভিয়েতনাম পণ্য পাঠাতে হয়। সেখান থেকে তা ইউরোপ-আমেরিকায় যায়। অথচ এখান থেকে সরাসরি যাওয়ার কথা ছিল। শিপিং ব্যবস্থা উন্নত না হলে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়বে না।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি সাইদুল ইসলাম। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাঈনুল আলম।

এমএ