সাংবাদিকতায় মেয়েদের যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রমোশন (পদোন্নতি) দেওয়া হয় না। তাদের খুব বড় পজিশনে যেতে দেওয়া হয় না। এখনও সমাজ মনে করে, পুরুষেরই ওই প্রমোশনটা দরকার। পুরুষকে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়। যারা ওই সিদ্ধান্তগুলো নেবেন, তারাও তো পুরুষ। তাই তারা ওইভাবেই জিনিসগুলো চিন্তা করেন...

ফরিদা ইয়াসমিন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ২০২১-২২ সালের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম নারী সভাপতি। সাংবাদিকতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আসতে তাকে পার করতে হয়েছে অনেক বাধা। সব বাধা অতিক্রম করে সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পদক, উইমেন লিড দ্য নেশন পুরস্কার এবং জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক সম্মাননা। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে এ পেশায় অর্জন করেছেন বিস্তর অভিজ্ঞতা। যেসব নারী পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন কিংবা নতুন করে যুক্ত হতে চান, অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে তাদের জন্য দিয়েছেন পরামর্শও।

আজ (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সাংবাদিকতায় নারী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও পেশাটি নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক হাসনাত নাঈম

ঢাকা পোস্ট : সাংবাদিকতার শুরুটা হয়েছিল কীভাবে?

ফরিদা ইয়াসমিন : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা শেষে এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। ১৯৮৯ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিভিন্ন কাগজে লেখালেখি করেছি। সাপ্তাহিক কাগজগুলোতে কাভার স্টোরি করেছি। ১৯৮৯ সালে ওয়েজবোর্ডের অধীন ‘বাংলার বাণী’তে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করি। এটি ছিল সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রথম কাজ।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে এর আগে কখনও মেয়েরা খুব বড় পদে আসেনি। এটাকে আমি টার্গেট হিসেবে নিয়েছিলাম। ফলে দুবার সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি

ফরিদা ইয়াসমিন, সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

ঢাকা পোস্ট : আপনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রথম নারী সভাপতি। নারী সাংবাদিক হিসেবে এটি কত বড় পাওয়া বলে আপনি মনে করেন?

ফরিদা ইয়াসমিন : আজ এই অবস্থানে আসতে আমাকে অবশ্যই অনেক কিছু পার হয়ে আসতে হয়েছে। একটি মেয়ের জন্য এই জায়গায় আসাটা খুব একটা সহজ না। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এর আগে কখনও মেয়েরা খুব বড় পদে আসেনি। এটাকে আমি টার্গেট হিসেবে নিয়েছিলাম। ফলে দুবার সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে আমি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি অবশ্যই মনে করি, এটি নারীদের জন্য একটি মাইলফলক। শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত অর্জন না, সব নারীর অর্জন। এর মাধ্যমে নারীরা উদ্বুদ্ধ হবে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে। যেহেতু আমাদের সমাজ নারীকে একটু অন্যভাবে চিন্তা করে। পারবে কি পারবে না, এই ধরনের একটা মানসিকতা কাজ করে। তাই অর্জনটা সব নারীর বলে আমি মনে করি।

সাংবাদিকতায় মেয়েদের যোগ্যতা থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হয় না— ফরিদা ইয়াসমিন

ঢাকা পোস্ট : মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকতায় নারীরা পিছিয়ে কেন?

ফরিদা ইয়াসমিন : এই সময়ে এসে আমরা যেটা ভেবেছিলাম, সবকিছু খুব স্মুথলি (সাবলীল) চলবে। নারীদের কোনোরকম কেউ হ্যারাস (হয়রানি) করবে না, কোনো বাজে কথা বলবে না। কিন্তু সেটি এখনও হয়ে ওঠেনি। যেহেতু পুরো সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক, তাই নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিটাও পুরুষতান্ত্রিক। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন হয়তো মানুষ ভাবতেই পারত না একটা মেয়ে রাত-বিরাতে কাজ করবে, কিংবা মাঠে-ঘাটে দৌড়াবে। মানুষ কিন্তু সেখান থেকে এখন অনেক দূরে সরে এসেছে। মেনে নিয়েছে, ছেলে-মেয়ে সমানভাবে কাজ করতে পারে। সে মাঠেও কাজ করতে পারে, রাত-বিরাতেও কাজ করতে পারে। কিন্তু ঠিক নারীবান্ধব পরিবেশ এখনও সব জায়গায় তৈরি হয়নি। সবার কথা বলছি না, তবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির যদি পরিবর্তন না হয় মেয়েরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে না।

মানুষ কিন্তু সেখান থেকে এখন অনেক দূরে সরে এসেছে। মেনে নিয়েছে, ছেলে-মেয়ে সমানভাবে কাজ করতে পারে। সে মাঠেও কাজ করতে পারে, রাত-বিরাতেও কাজ করতে পারে। কিন্তু ঠিক নারীবান্ধব পরিবেশ এখনও সব জায়গায় তৈরি হয়নি। সবার কথা বলছি না, তবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির যদি পরিবর্তন না হয় মেয়েরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে না

ফরিদা ইয়াসমিন, সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

ঢাকা পোস্ট : নারী বলে কর্মস্থলে কি কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়, হলে সেগুলো কেমন?

ফরিদা ইয়াসমিন : আমি মনে করি, সাংবাদিকতায় মেয়েদের যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রমোশন (পদোন্নতি) দেওয়া হয় না। তাদের খুব বড় পজিশনে যেতে দেওয়া হয় না। সব জায়গায় দেখি, একটা পর্যায়ের পর তাকে আটকে দেওয়া হয়। একটি মেয়ে নির্বাহী সম্পাদক, সম্পাদক কিংবা বার্তা সম্পাদক হবেন—এগুলো কিন্তু আমরা এখনও দেখি না পত্রিকাগুলোতে। এখনও সমাজ মনে করে, পুরুষেরই ওই প্রমোশনটা দরকার। পুরুষকে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়। যারা ওই সিদ্ধান্তগুলো নেবেন তারাও তো পুরুষ। তাই, তারা ওইভাবে জিনিসগুলো চিন্তা করেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের ২০২১-২২ সালের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম নারী সভাপতি নির্বাচিত হন ফরিদা ইয়াসমিন

ঢাকা পোস্ট : অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নারীদের সংখ্যা খুবই কম হওয়ার কারণ কী?

ফরিদা ইয়াসমিন : আমি বলছি না যে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় মেয়েদের কম দেখা যায় আর ছেলেদের খুব বেশি দেখা যায়। কারণ, এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ওই অর্থে আমাদের দেশে হচ্ছে না। মেয়েদের বেলায় বলতে হলে, আমি প্রথম আলোর রোজিনা ইসলামের নাম বলতে চাই। অনেক ভালো রিপোর্ট (প্রতিবেদন) করেছে, যেগুলো আলোড়ন তৈরি করেছে। সেই ক্ষেত্রে পুরুষরাও সেরকম রিপোর্ট করেনি। পুরুষ সমাজ হয়তো সেভাবে স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু মেয়েরা ভালো কাজ করছে। মেয়েদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো আছেই।

সাংবাদিকতা অনিশ্চিত পেশা। আজ চাকরি আছে তো কাল নাও থাকতে পারে। তোমাকে এই পেশায় আসতে হলে পেশাটিকে ভালোবাসতে হবে। কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাস) থাকতে হবে, আমি পারি, পারব এবং করব

ফরিদা ইয়াসমিন, সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

ঢাকা পোস্ট : এ পেশায় আসতে চাওয়া নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে?

ফরিদা ইয়াসমিন : সাংবাদিকতা অন্য আর দশটা পেশার মতো না। সরকারি চাকরিতে নিশ্চিত থাকা যায়। কিন্তু সাংবাদিকতা একটি অনিশ্চিত পেশা। বারবারই বলব, এটি অনিশ্চিত পেশা। আজ চাকরি আছে তো কাল নাও থাকতে পারে। তোমাকে এই পেশায় আসতে হলে পেশাটিকে ভালোবাসতে হবে। অনেক চড়াই-উৎরাই থাকবে এবং আমি সেখানে টিকে থাকব। টিকে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। এই কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাস) থাকতে হবে, আমি পারি, পারব এবং করব। চোখ-কান সবসময় খোলা রাখতে হবে এবং ভালো পড়াশোনা জানতে হবে। কখন, কোথায়, কী ঘটছে–সব বিষয়ে আপ-টু-ডেট থাকতে হবে।

এক নজরে ফরিদা ইয়াসমিন

ফরিদা ইয়াসমিন ১৯৬৩ সালের ১ জুন নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার দৌলতকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নরসিংদী জেলার শিবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতায় উচ্চতর প্রশিক্ষণও নেন।

ফরিদা ইয়াসমিন ১৯৮৯ সালে বাংলার বাণী পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এর আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। বাংলার বাণী ছাড়াও তিনি মুক্তকণ্ঠে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কর্মরত আছেন। ২০০১ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হন ফরিদা ইয়াসমিন।

২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭-১৮ এবং ২০১৯-২০ সালে প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। বর্তমানে ২০২১-২২ সালের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম নারী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সাউথ এশিয়ান উইমেনস মিডিয়া ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক এবং ফোরামটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০১৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

এমএইচএন/এফআর/এমএআর/এমএমজে