নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৫ সদস্যকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রাজধানীর গুলিস্তান থেকে গ্রেপ্তার করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব।

র‌্যাব বলছে, গাইবান্ধায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর (পুলিশ সদস্য) এক সদস্য ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করায় জঙ্গি সংগঠনটির উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় হত্যার পরিকল্পনা করছিল। হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৩-৪ জন সদস্য একত্রিতও হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই গ্রেপ্তার করা হয় ৫ সদস্যকে।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রাজধানীর গুলিস্তানে সংগঠনের অর্থায়নে ‘ট্রাস্ট টেলিকম’ নামে একটি মোবাইল এক্সোসরিজের দোকান পরিচালনা করা হতো এবং দোকানের লভ্যাংশ সংগঠনের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যয় করতো। এছাড়াও মুন্সীগঞ্জে একটি গরু-ছাগলের খামার পরিচালনা করা হতো। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের খামারে গিয়ে মিটিং করতো। পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য ১ম পর্যায়ে ১২ জন সদস্যকে পাঠানোর সময়ে এই খামারে সবাইকে একত্রিত করা হয়েছিল।

সোমবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত রাতে র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রাজধানীর গুলিস্তান এলাকা হতে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন কুমিল্লার লাকসামের মৃত মনিরুজ্জামানের ছেলে মো. গোলাম সারোয়ার (২৫), গাইবান্ধা সদরের শাহিন মাহমুদের পুত্র সাকিব মাহমুদ (২৭), মুন্সীগঞ্জ সদরের মৃত মোহন বেপারীর দুই ছেলে ফরহাদ হোসেন (২২), ও মো. মুরাদ হোসেন (২১) এবং ফরিদপুর নগরকান্দার মৃত রকিবুল হাফিজের ছেলে ওয়াসিকুর রহমান ওরফে নাঈম (২৮)। গ্রেপ্তারকালে তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় বিভিন্ন উগ্রবাদী বই ও লিফলেট, ১টি রেজিস্টার খাতা ও ১টি ব্যাগ।

গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, তারা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়াতী, হিজরতকৃত সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধান, পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা ২/৪ বছর পূর্বে নিকটাত্মীয়, বন্ধু ও স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের মাধ্যমে তাত্ত্বিক, শারীরিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

সাম্প্রতিক সময়ে জামাতুল আনসারের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের কারণে তারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে আত্মগোপনে থাকে এবং সংগঠনে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা সংগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতো।

গ্রেপ্তার গোলাম সারোয়ার স্থানীয় একটি মাদ্রাসা হতে ফাজিল সম্পন্ন করে। সে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে একটি মিষ্টির দোকানে চাকরি করতো। সে পূর্বে গ্রেপ্তার নেয়ামত উল্লাহর মেয়ের জামাতা। সে তার শ্বশুরের মাধ্যমে দুই বছর পূর্বে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া তরুণদেরকে কুমিল্লার বিভিন্ন সেইফ হাউজে রাখা ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রেরণ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে সে জড়িত ছিল।

বিভিন্ন সেইফ হাউজে অবস্থানকৃত হিজরতকারীদের শারীরিক ও তাত্ত্বিক বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। এছাড়াও সে তথাকথিত হিজরতকৃত সদস্যদের বিভিন্ন সেইফ হাউজে পৌঁছে দিত বলে জানা যায়। সে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত ছিল। বিগত সময়ে কুমিল্লা হতে নেহাল, আসমানি ও নিলয় নামে তিন তরুণের নিখোঁজের ঘটনায় কুমিল্লার দৌলতগঞ্জ রেলস্টেশনের নিকটবর্তী সিসিটিভি ফুটেজে গ্রেপ্তার সারওয়ারকে একসঙ্গে দেখা গেছে।

গ্রেপ্তার সাকিব মাহমুদ গাইবান্ধা হতে মাধ্যমিক সম্পন্ন করে। সে একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং এ কাজ করতো। সে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য, উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের তত্ত্বাবধায়ক শামীম মাহফুজের আপন ভাতিজা। সে ৩ বছর পূর্বে শামীম মাহফুজের মাধ্যমে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সংগঠনে যোগদান করে। সে গাইবান্ধা অঞ্চলে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়াও তিনি শামীম মাহফুজের নির্দেশনায় গাইবান্ধা অঞ্চলে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আদর্শে উদ্বুদ্ধ সদস্যদেরকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে পাঠানো কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত ছিল এবং সে সংগঠনের একজন সশস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য।

সংগঠনটির নাশকতা, সুনির্দিষ্ট কোনো স্থাপনা ও ব্যক্তির ওপর হামলার পরিকল্পনা ছিল কিনা জানতে চাইলে র‌্যাব মুখপাত্র মঈন বলেন, গাইবান্ধায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করেছিলেন মর্মে তারা সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সাকিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে আরও ৩-৪ জন সদস্যকে একত্রিত করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই সাকিবকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে।

তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে গাইবান্ধা সদর থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তার দুই সহোদর ফরহাদ হোসেন ও মুরাদ হোসেন সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ফরহাদ স্থানীয় কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে এবং মুরাদ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে। তারা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সংগঠনের সূরা সদস্য এবং অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবের শ্যালক। ৩ বছর পূর্বে মোশারফ হোসেনের মাধ্যমে তারা সংগঠনে জড়ায়। তারা রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় সংগঠনের অর্থ দিয়ে ‘ট্রাস্ট টেলিকম’ নামে একটি মোবাইল এক্সোসরিজের দোকান পরিচালনা করতো এবং দোকানের লভ্যাংশ সংগঠনের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যয় করতো।

এছাড়াও মুন্সীগঞ্জে তারা একটি গরু-ছাগলের খামার পরিচালনা করতো। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের খামারে গিয়ে মিটিং করত বলে জানা যায়। এছাড়াও তারা পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য ১ম পর্যায়ে ১২ জন সদস্যকে প্রেরণকালীন এই খামারে সবাইকে একত্রিত করে বলে তারা জানায়। পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, বস্ত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যাদি এবং বোমা তৈরির জন্য কতিপয় সামগ্রীসমূহ গ্রেপ্তার ফরহাদ ও মুরাদ সংগ্রহ করতো এবং পরবর্তীতে সামগ্রীসমূহ মগবাজারে গ্রেপ্তারকৃত ওয়াসিকুর রহমান নাঈমের কাছে পৌঁছে দিতো।

গ্রেপ্তার ওয়াসিকুর রহমান রাজধানীর একটি মাদ্রাসা থেকে হিফজ সম্পন্ন করে। ২ বছর পূর্বে সে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সংগঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। সে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় সংগঠনের অর্থ দিয়ে ‘ষোল আনা’ নামক একটি আতরের দোকান পরিচালনা করতো এবং দোকানে লভ্যাংশ সংগঠনের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যয় করতো।

সে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রম ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। গ্রেপ্তার ফরহাদ ও মুরাদ পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, বস্ত্র সামগ্রী ও বোমা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করে গ্রেপ্তার ওয়াসিকুরের ‘ষোল আনা’ নামক আতরের দোকানে পৌঁছে দিতো। পরবর্তীতে সে বিভিন্ন মাধ্যমে তা পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করত বলে জানা যায়। 

এখানে উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে বেশ কয়েকজন তরুণ উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। এলিট ফোর্স র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে ঘর ছেড়ে উগ্রবাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল ৪ তরুণকে উদ্ধার পূর্বক ডি-র‌্যাডিক্যালাইজড করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

এছাড়াও, কুমিল্লা হতে নিখোঁজ এক তরুণ নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। পরে বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৬ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লাসহ অন্যান্য অঞ্চল হতে নিখোঁজ ৪ জন তরুণ ও উগ্রবাদী সংগঠনের দাওয়াতী, তত্ত্বাবধান, প্রশিক্ষণ, আশ্রয় প্রদান ও অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ৩ জনসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ হতে উগ্রবাদী সংগঠনটির দাওয়াতি ও অন্যতম অর্থসরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ ও নিরুদ্দেশ ৩ তরুণসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ তরুণদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে গত ২১ অক্টোবর অভিযান পরিচালনা করে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ শূরা সদস্য সৈয়দ মারুফ আহমদ ওরফে মানিকসহ ৭ জন এবং পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ৩ জনসহ মোট ১০ জনকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

এছাড়াও গত ৩ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার লাকসাম থেকে সংগঠনের অর্থবিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির আহম্মেদ ওরফে বাচ্চু, হিজরতকৃত সদস্যদের সার্বিক সমন্বয় সুজন ওরফে সোহেল ও ইসমাইল হোসেন ওরফে হানজালা এবং সামরিক শাখার ৩য় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হেলাল আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ৯ নভেম্বর সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী দুই সদস্যসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

জেইউ/এমএ