জয়গুন বেগমের বয়স ৭৫ বছর। কয়েক বছর হলো তার স্বামী মারা গেছেন। বর্তমানে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নে বসবাস করলেও জয়গুনের স্বামীর আদি ভিটা ছিল জেলার সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাটি এলাকায়। জীবনের তাগিদে স্বামীর সঙ্গে তিনি নলডাঙ্গায় আসেন। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানহীন জয়গুনকে দেখার কেউ নেই। ফলে অসহায়ত্বকে সঙ্গী করে টিকে থাকার যুদ্ধে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য হন তিনি।

কয়েক বছর ধরে ভিক্ষা করে চলছে জয়গুনের জীবন। একদিন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পারলেন কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাটি এলাকায় তার শ্বশুরের নামে জমি আছে। আইন অনুযায়ী সেই জমিতে ভাগ পান তার স্বামী। স্বামীর জমি থেকে একটি অংশ পাবেন জয়গুন। জমির পরিমাণও কম নয়, মোট ১৮ বিঘা। এ জমির মালিক এখন জয়গুনের স্বামী ও তার ভাই। জানা গেছে, একই এলাকায় আরও দুটি স্থানে তাদের জমি আছে। আইন অনুযায়ী সেখান থেকেও জমি পাবেন জয়গুন। 

কিন্তু জয়গুন বেগম কীভাবে নিশ্চিত হবেন তার স্বামী সত্যি সত্যি ওই জমির মালিক? কাগজপত্র দেখে একটু নিশ্চিত হওয়া গেলে ভালো লাগত তার!

অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরির পর জয়গুন জানতে পারেন, সরকারের এটুআই প্রকল্পের ডিজিটাল সেন্টারের বিষয়ে। সেখান থেকে সব তথ্যই পাওয়া যাবে বলে তাকে জানান এলাকাবাসী। এরপর জয়গুন বেগম তার দেবরকে (স্বামীর ভাই) সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদে। সেখানে থাকা ডিজিটাল সেন্টারে তার সব কথা খুলে বলেন। ওই সেন্টারের উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্ট সার্ভিস ব্যবহার করে ভূমি অফিসের অ্যাকসেস থেকে জয়গুন বেগমকে জানিয়ে দেন, সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী সেই জমির মালিক তার শ্বশুর এবং সেই সূত্রে এখন তারাই।

কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে কথা হয় জয়গুন বেগমের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ভিক্ষা করে চলি। আমার স্বামীর ভাগে এতগুলো জমি আছে জানতাম না। ডিজিটাল সেন্টার না থাকলে সে তথ্য আমি কখনোই জানতে পারতাম না। জমির সন্ধান তো পেতামই না। এছাড়া আরও যে দুই স্থানে আমাদের জমি আছে সেখানে নামের একটু ভুল আছে বলে জেনেছি। তা ঠিক করার কাজও এই ডিজিটাল সেন্টার থেকে করে দেবে বলেছে। জমিগুলো সময়মতো পেয়ে গেলে শেষ বয়সে আমার আর ভিক্ষা করে খেতে হবে না।

জয়গুন বেগমের সঙ্গে কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে এসেছেন তার দেবর আসকার আলী। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ, কে কাকে দেখব। ভাই মরে যাওয়ার পর ভাবি তাই ভিক্ষা করে চলেন। কিন্তু আমার বাপের নামে যে এতগুলো জমি আছে আমরা তা জানতাম না। লোকমুখে জানার পর এখানে এসেছি। এই জমি হাতে পেলে আমাদের জীবন বদলে যাবে, আমার ভাবিকে আর ভিক্ষা করতে হবে না। জমি পাওয়ার পর ভাবিসহ আমরা সবাই তা ভাগ করে নেব। বিষয়টি সহজে জানা সম্ভব হয়েছে এই সেন্টারের কল্যাণে।

গাইবান্ধা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কামারজানি ইউনিয়ন। এটি মূলত ব্রহ্মপুত্র তীরের একটি চরাঞ্চল। নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে এখানকার লোকজন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে আসেন। এখান থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের সেবা নেন। আগে এসব কাজের জন্য তাদের গাইবান্ধা শহরে যেতে হতো। 

জানা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দোরগোড়ায় দ্রুত ও স্বল্পমূল্যে সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় ‘এটুআই’ কাজ করছে। এটুআই-এর বিভিন্ন উদ্যোগের একটি হলো ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। এর মাধ্যমে সরকারি সেবা নেওয়ার সময়, খরচ এবং যাতায়াতের সাশ্রয় হচ্ছে। যার ফলে জনগণ আরও বেশি সেবা নিতে আগ্রহী হচ্ছেন। সাধারণ অনেক তথ্য, যেগুলো নিতে আগে শহরের সরকারি অফিসে যেতে হতো, সেগুলো এখন অনলাইনে নিতে পারছেন সাধারণ মানুষ। এই প্রক্রিয়া থেকে আরও বেশি রাজস্ব আয় সম্ভব হচ্ছে, যা উন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করছে। 

খুব সকালে চর থেকে কামারজানি ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে এসেছেন এরশাদ আলী নামের এক কৃষক। মূলত তিনি তার উৎপাদিত পণ্য কামারজানিতে বিক্রি করে বাজার করে ঘরে ফিরবেন। একটি পেমেন্ট করতে তিনি এর ফাঁকে এসেছেন কামারজানি ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে। তিনি বলেন, আগে এই টাকাটা জমা দিতে যেতে হতো গাইবান্ধা সদরে। সেজন্য যেমন টাকা খরচ হতো, তেমনি সময়ও লাগতো অনেক। কিন্তু এই ডিজিটাল সেন্টারে এসব সেবা পেয়ে আমাদের খুব উপকার হয়েছে। কাজের ফাঁকে এখানে এসে অন্য কাজগুলো সেরে নেওয়া যাচ্ছে।

রেজাউল করিমের ঘরও নদীর ওপারে। তিনি তার সন্তানের জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে এসেছেন কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে। তিনিও জানালেন আগের ভোগান্তির কথা। রেজাউল করিম বলেন, আমার প্রথম সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করতে খুব ভোগান্তি হয়েছে, সদরে গিয়ে ঘুরতে হতো। এখন এখানে ডিজিটাল সেন্টার থাকায় খুব সহজেই আবেদন করা গেল। শুধু জন্ম নিবন্ধনের আবেদনই নয়, আমাদের চর এলাকার সব মানুষ এখান থেকে সব ধরনের কাজ সহজেই করে নিতে পারে। আমাদের আর ১৪ কিলোমিটার দূরে সদরে গিয়ে কাজ করার ভোগান্তি পোহাতে হয় না।

জানা গেছে, জমির নকল, আরএস, সিএস, এসএ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার কম্পোজ, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ আবেদন, অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির আবেদন, সরকারি যেকোনো ফরম, যেকোনো পরীক্ষার ফল, চাকরি বিজ্ঞপ্তি, ছবি তোলা, ফটোকপি করা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ই-মেইল করা, স্ক্যানিং, অনলাইনে পাসপোর্ট আবেদন, অনলাইনে পর্চার আবেদন, অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন, হজ যাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধন, পল্লি বিদ্যুৎ বিল জমা, অনলাইনে বিদ্যুৎ মিটারের আবেদন, ওয়ারিশ সনদের আবেদন, চারিত্রিক সনদসহ নানা সেবা পাওয়া যায় ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে।

এটুআইয়ের কমিউনিকেশনস অ্যান্ড আউটরিচ কনসালটেন্ট আদনান ফয়সাল বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ৮০৫টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ৩৫০টিরও বেশি সেবা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার নাগরিকদের যে সেবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নিতে হতো, কিন্তু ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সহজে কম সময়ে ও কম খরচে ডিজিটাল সেন্টার থেকে তারা সে সেবা নিতে পারছেন। জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃত। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এরইমধ্যে নাগরিকদের প্রায় ৮০ কোটিরও বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৬ হাজার ৪শর বেশি উদ্যোক্তা ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা দেওয়ার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এরমধ্যে ৫ হাজার ২শর বেশি নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, এটুআই এর বিভিন্ন উদ্যোগের সেবা সহজ করার মাধ্যমে সরকারি সেবা গ্রহণের সময়, খরচ এবং যাতায়াতের সমস্যা দূর হয়েছৈ। যার ফলে জনগণ আরও বেশি সেবা নিতে আগ্রহী হচ্ছেন। সাধারণ তথ্য যেগুলো নিতে তাদেরকে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া এবং পায়ে হেঁটে অফিসগুলোতে যেতে হতো, এখন তা অনলাইনে নিতে পারছেন।

ডিজিটাল সেন্টারে নাগরিকদের সেবা সহজ করার বিষয়ে কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত 'ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার' পরিষদকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমি চেয়ারম্যান হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আরও বেশি প্রশংসা পাচ্ছি, কারণ সাধারণ মানুষ খুব সহজেই ইউনিয়ন পরিষদে এসে তাদের সব ধরনের সেবা পেয়ে যাচ্ছেন। একজন মানুষকে এসে এখন আর কাজের জন্য ঘুরতে হচ্ছে না, আমাদের যেসব কাজগুলো ছিলো সেগুলোকে সহজ করে দিয়েছে এই ডিজিটাল সেন্টার। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, জন্ম নিবন্ধনের আবেদন, চালের কার্ড এসব কাজ অনলাইনের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। 

ডিজিটাল সেন্টারের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় কামারজানি ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন আমাদের এই ডিজিটাল সেন্টার ছিলো না তখন এসব এলাকার মানুষকে প্রথমে নদী পেরিয়ে পরে গাড়িতে ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সদরে গিয়ে যেকোনো কাজ করতে হয়েছে কাজের জন্য। কিন্তু এখন তারা সব সেবাই এই ডিজিটাল সেন্টারে পেয়ে যাচ্ছেন। এতে করে এসব দরিদ্র মানুষের যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়েছে, তেমনি সময়ও সাশ্রয় হয়েছে। আমরা এখান থেকে কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের সব সেবা দিয়ে থাকি। এছাড়া নদী এলাকা হওয়ায় প্রতি বছর নদী ভাঙনে এলাকাবাসীর জমির সীমানা হারিয়ে যায়। তাই জমির পর্চার সেবা আমাদের এখানে খুবই জনপ্রিয় একটি সেবা, যা আমরা এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে দিয়ে থাকি। সব মিলিয়ে প্রতিদিন আমরা গড়ে ১০০ বা তার চেয়ে বেশি মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকি। এক কথায় এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের কাছে ভোগান্তিহীন সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এএসএস/জেডএস